আঁতিপাঁতি / আতিপাতি

ওমর ফারুক


শব্দ সব সময়ই সরব। শব্দের শক্তি প্রচ্ছন্ন। আবার অনেক সময় শব্দ ভীষণ রকম শব্দ করে নিজের সক্ষমতা জানান দেয়। শব্দের ব্যবহার বিধি সব ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শব্দ ব্যবহারে সচেতন থাকতে হয়, নইলে অহেতুক অনাচার ঘটতে পারে। অনেক সময় শব্দ বোমার মতো কাজ করে, ভয় ধরায়। আবার অনেকে সময় যুৎসই শব্দ ব্যবহার না করার কারণে অর্থের পরিবর্তন হয়,ভীষণ অনর্থ ঘটে যায়। আবার শব্দ রুচির পরিচয় বহন করে। আর এ কারণেই শব্দ নিয়ে ভাষা বিজ্ঞানের নানা পরীক্ষা, নীরিক্ষা, ব্যবচ্ছেদ। এই ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে অনেক সময় মূল শব্দের ধাতুমূল আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন শব্দটি ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে।

বাংলাভাষার অধিকাংশ শব্দই বিদেশি। এর মানে তৎসম এবং তদ্ভব। বিদেশি শব্দের মধ্যে ফারসি,ফরাসি, আরবি,ইংরেজির প্রাধান্য বেশি।কিছু চীনা,জাপানি আর গুজরাটি শব্দ বাংলাভাষায় ঢুকে গেছে। এসব শব্দ এখন বাংলা ভাষার সম্পদ। সব শব্দ নিয়ে এদেশে হট্টগোল হয়নি। কিছু শব্দের ব্যবহার এবং প্রয়োগের জন্য শব্দগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের নিকট আলোচনা আর আগ্রহে পরিণত হয়েছে। এমনি কিছু শব্দ নিয়ে কথা বলা যাক। হরতাল শব্দটি এসেছে মহাত্মা গান্ধীর জন্মস্থান গুজরাট থেকে। সেখানে এ শব্দের প্রয়োগ না থাকলেও আমাদের দেশে জনগণের ঘাম ছুটিয়েছে হরতাল। “হারিকিরি “শব্দটি জাপানি। এর অর্থ আত্মহত্যা। বাংলায় এর ব্যবহার নেই। কিন্তু একজন বিখ্যাত লেখক শব্দটি ব্যবহার করার কারণে এর ব্যবহার বাড়ে বলার ক্ষেত্রে। কারণ এসব শব্দ লৈখিক মর্যাদা পায়নি। এ শব্দগুলো মূলত মৌখিক পরম্পরায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আরবি একটি শব্দ ” হারফুনমৌলা “।এর অর্থ সকল কাজের কাজী। বাংলায় আমরা বলি “সবজান্তা”। মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে ” হারফুনমৌলা ” শব্দটির ব্যবহার রয়েছে। বাংলা শিক্ষায় “সবজান্তা ” শব্দটিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এসব শব্দ সম্পূরক নয়। আমাদের শব্দের জোর বিদেশি ভাষার শব্দের সম্পূরক হবেনা। ক্যান্সারের বাংলা আমরা” কর্কট “করেছি, যেটা সাধারণের বোধগম্য নয়। ডায়াবেটিস এর বাংলা করেছি বহুমূত্র। কিডনির বাংলা করেছি “যকৃত”।

শব্দ নিয়ে মাঝেমধ্যে জব্দ হতে হয়। আমরা পোলারাইজেশনের বাংলা করেছি মেরুকরণ। শব্দ নিয়মিতই আমাদের মধ্যে বিভেদ আর বিসম্বাদ বাড়িয়ে তুলছে। এর কারণ শব্দ ব্যবহারে অসচেতনতা। শিশুদের নিকট সব শব্দের ব্যাখ্যা দেয়া যায়না, শব্দ বিভ্রম সৃষ্টি করে, বিব্রত করে, বিভ্রান্তি বাড়ায়। শব্দ ব্যবহার করে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। কমিউনিজমের বাংলা কখনোই সাম্যবাদ হতে পারেনা। টেরোরিস্ট এর মধ্যেই তো ভয়। এর যুৎসই বাংলা কখনো ব্যবহার হয়না। সন্ত্রাস, সন্ত্রাসী যখন ব্যবহৃত হয় তখন মনের অজান্তেই ভয় ঢুকে যায়। এর ফলে শব্দের মূল অর্থ প্রতিভাত হয়না। যদি আতংক বাদি ব্যবহার করা হতো তাহলে ভয় নয় শব্দ দিয়ে,আওয়াজ দিয়েই বেড়াল চেনা যেত। শব্দ দিয়েই তার স্বভাব, আচরণ, নিত্যতা চেনা যায়।

বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ ধর্ষণ। ইংরেজিতে যতটা সহজে আর সাবলীলভাবে বলা যায় বাংলায় ততোটাই বিব্রত হতে হয়। শব্দটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং বিচ্ছিন্ন। এরকম বিব্রতকর শব্দ বাংলায় অনেক আছে। যেমন, লিঙ্গ, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, মৌলবাদ, হাজাম, সাম্রাজ্যবাদ, বুর্জোয়া, সামন্তবাদ, প্রলেতারিয়া, ইলুমিনাতি। ধর্ষণ শব্দ ব্যবহারে আধিক্য বাড়ে, অপরাধ মাথা চাড়া দেয়, উৎসাহিত হয়। কিন্তু বলাৎকার শব্দে নেই কোনো আকর্ষণ, নেই টান, নেই অপরাধের চিহ্ন। এজন্য শব্দ ব্যবহারে সতর্কতা এবং সচেতনতা আবশ্যক।

একই শব্দে বিভিন্ন অর্থ আছে, আছে উচ্চারণে ভিন্নতা। আবার শব্দের উৎপত্তি আর বুৎপত্তিগত অর্থও অভিন্ন নয়। অনেক শব্দ আদিতে, কেউ মধ্য,কেউ প্রান্ত বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে ধ্বনির ক্রমধারা বজায় রেখেছে। আবার আঞ্চলিকতার প্রভাব তো রয়েছেই। সচেতন হয়ে যায় সতেচন। নজরুল হয়ে যায় নরজুল। তরমুজ হয়ে যায় তমরুজ। বাক্স হয়ে যায় বাসকো। অভিশাপ হয়ে যায় অধিশাপ। ধ্বনির বিপর্যয় বড় বিষয় নয়। এরচেয়েও বড় যে বিষয় সেটা ঘটেছে বিজ্ঞজনের কলামে। এদেশের অনেক লেখক, সাহিত্যিক নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে ভাষা এবং বানানে ভিন্নতার সৃষ্টি করেছেন। এর ফলে বাংলাভাষা এবং এর শব্দ সমষ্টি স্থায়ী রূপ লাভ করতে পারেনি। এদেশের বিজ্ঞজনের অনেকে নিজের জন্য স্বাতন্ত্র্য ভাষাও পয়দা করেছেন। লেখক জসীম উদদীন, শামসুর রাহমান, রেহমান সোবহান, শেখ ফজলল করীম ,অমর্ত্য সেন প্রমুখ। এদের নামের বানান বিদঘুটে। এ কারণে সাধরণের সমস্যা হয়। এ শব্দগুলোকে অনেকে বলে পাজি বানান।

ভাষা বা শব্দ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রথম পথ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি যে শব্দ ব্যবহার করতেন বা যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করতেন সে ধারা অনেককাল বেঁচে ছিলো। রবীন্দ্রনাথকে গুরু মেনে অনেকে রাবীন্দ্রিক ভাষা সৃষ্টির পায়তারা করেছিলেন। করলুম, খেলুম, গেলুম বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। তবে রবীন্দ্রনাথের ব্যাবসা, ব্যাথা হাল আমলে বাংলা একাডেমি আমলে নিয়েছে। বাংলা একাডেমি খুঁজে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথ ১৯২৭ সাল অবধি “গোরু” বানান লিখতেন। তারপর তাঁর মতিভ্রম হয়। রবীন্দ্রনাথের মতো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “পথের পাচালি” উপন্যাসে “গোরু” বানান লিখেছেন। নজরুল “গোরু”, গরু দুটোই লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৬ সালেই বাংলাভাষা ও শব্দের উপর নিজের আধিপত্য বিস্তারে প্রয়াস পেয়েছিলেন। আহমদ ছফা, রোকেয়া, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিমচন্দ্র এদের নিজস্ব ভাষা রীতি আছে। এরা বানানের ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতেন। গোরু বানান মধ্যযুগের প্রায় লেখকের রচনাতেই পাওয়া যায়। তবে ঈদ বানান সবার লেখাতেই,কোথাও ইদ পেলাম না। বাংলা একাডেমি কাকে অনুসরণ করছে বলা যায়না। এবছর কোন বানান নিয়ে হাজির হয় দেখার বিষয়।

হাল আমলে শব্দ নিয়ে নতুন করে খেলা শুরু হয়েছে। শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে শব্দের অণুসঙ্গ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অতিমাত্রায় বাংলিশ শব্দ প্রয়োগ, ভুল প্রয়োগ, বিকৃত উচ্চারণ শব্দের অর্থে পরিবর্তন এনেছে। কিছু কিছু এফ এম রেডিও এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। হালে কিছু শব্দে আ-কার, ই- কার যুক্ত হয়ে শব্দের প্রতি মোহ সৃষ্টি করেছে। ইসলামি অনেক মাসিক পত্রিকায়” এসলাম “এবাদত, সেহরি,নমজ/নমাজ,মহম্মদ, রেজেক, শয়তান, এতেকাফ, হজ্জ্ব, সেরাত, মওলুদ, যকাত, সদকা, এফতারি, বেতের, ফেতের, ক্বেবলা প্রভৃতি লেখা থাকতো। হালে শব্দগুলো এমনভাবে দাঁতে দাঁত চেপে আ- কার, ই- কার যুক্ত করে উচ্চারিত হবার কারণে মূল শব্দের আবেদন বিনষ্ট হচ্ছে।

শব্দ দিয়ে ভয় ধরানো হয়,মোহ সৃষ্টি করা হয়। ধ্বনির বিপর্যয় নিয়ে বাংলা একাডেমি লা- জবাব। তাদের যতো কাজ শব্দ নিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি। বিশাল কর্মযজ্ঞ ফেলে রেখে একাডেমি প্রতিবছর শব্দ নিয়ে পড়ে থাকে। শব্দ নিয়ে ভয় ততোদিন বর্তমান থাকবে যতোদিন শব্দের যুৎসই প্রয়োগ নিশ্চিত না করা যায়। আর এ কাজে বাংলা একাডেমি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।


লেখকঃ ওমর ফারুক 

মতামত দিনঃ