আজ থেকে ৪১,০০০ বছর আগে, এক সুদূর মহাজাগতিক শক্তির অমোঘ ইশারায় পাল্টে গিয়েছিল মানব ইতিহাসের চেনা গতিপথ।

এবং সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আবারও ঘটবে।

সেই সুপ্রাচীন কালে আমাদের এই পৃথিবী এক বিরল অথচ প্রচণ্ড ভূ-চৌম্বকীয় ওলটপালটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, যা বিজ্ঞানীদের কাছে “ল্যাশাম্প এক্সকারশন” (Laschamps Excursion) নামে পরিচিত। প্রতি কয়েক লক্ষ বছরে যে আমূল চৌম্বক মেরু পরিবর্তন ঘটে, এটি ঠিক তেমন দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। এই ঘটনাটি স্থায়ী হয়েছিল মাত্র কয়েক হাজার বছর, কিন্তু এর তীব্রতা ছিল অভাবনীয়।

এই বিপর্যয়ের সময়, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রটি দুর্বল হতে হতে তার স্বাভাবিক শক্তির দশ শতাংশেরও নিচে নেমে আসে। এটি তখন দুটি সুনির্দিষ্ট মেরুযুক্ত একটি স্থিতিশীল দণ্ড চুম্বকের মতো আচরণ না করে, বরং ছিন্নভিন্ন হয়ে অসংখ্য বিক্ষিপ্ত চৌম্বক মেরুতে পরিণত হয়। আমাদের গ্রহের চারপাশের যে অদৃশ্য সুরক্ষা বর্ম—সেই ম্যাগনেটোস্ফিয়ার (magnetosphere)—তা হয়ে পড়েছিল বিশৃঙ্খল, অস্থিতিশীল আর ভেদযোগ্য।

এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী এবং নাটকীয়। মেরুপ্রভার যে রঙিন খেলা সাধারণত পৃথিবীর দুই প্রান্তে সীমাবদ্ধ থাকে, তা হয়তো সেদিন ভূমধ্যসাগরের আকাশেও আলোর বন্যা বইয়ে দিয়েছিল।

৪১ হাজার বছর আগের যে ঘটনা মানব ইতিহাস বদলে দিয়েছিল 1
Manitoba, Canada — Aurora Borealis in Manitoba — Image by © Daniel J. Cox/Corbis

পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিল বিকিরণের (Radiation) মারাত্মক স্রোত। এর ফলে ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়েছিল রোদে পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা, চোখের ক্ষতি, জিনগত রূপান্তর এবং মারাত্মক জন্মগত ত্রুটির মতো ঝুঁকি।

এই অদৃশ্য অথচ সর্বগ্রাসী হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে, আমাদের পূর্বপুরুষ—হোমো সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথাল—উভয়েই অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে নিজেদের আচরণ বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল।

প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক প্রমাণগুলো সেই সময়ে মানুষের মাঝে তিনটি অভ্যাসের ব্যাপক বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করে:

  • গুহার আঁধারে আশ্রয়: সম্ভবত সর্বগ্রাসী অতিবেগুনি রশ্মি থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে তারা উন্মুক্ত প্রান্তর ছেড়েছিল।
  • বিশেষ পোশাকের ব্যবহার: অনাবৃত শরীরকে বিকিরণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচানোর এটি ছিল এক আদিম প্রচেষ্টা।
  • ত্বকে গিরিমাটির (ochre) প্রলেপ: এটিকে এতদিন কেবল আচার বা প্রসাধনী ভাবা হলেও, এটিই হয়তো ছিল পৃথিবীর প্রথম প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন।

সম্প্রতি ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ (Science Advances) জার্নালে প্রকাশিত একটি আন্তঃবিষয়ক গবেষণায় প্রত্নতত্ত্ব, ভূ-পদার্থবিদ্যা এবং জলবায়ু মডেলিং-এর আলোকে এই সুপ্রাচীন মহাজাগতিক দুর্যোগটির প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষকরা দেখেছেন, খাপ খাইয়ে নেওয়ার এই কৌশলগুলো বিশেষত ইউরোপজুড়ে (যেখানে চৌম্বক ক্ষেত্রের পতন সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল) দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।

সবচেয়ে আশঙ্কার কথাটি হলো, এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে—এবং নিঃসন্দেহে তা আবারও ঘটবে।

সেই প্রাচীন বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আদিম মানুষেরা কীভাবে টিকে ছিল, সেই গল্পই হয়তো ভবিষ্যতের দুর্দিনে আমাদের পথ দেখানোর সবচেয়ে বড় নীলনকশা হয়ে উঠতে পারে।

সোর্সঃ