অমোঘ প্রেম

প্রান্তর কর্মকার


এই পৃথিবীতে ভালোবাসা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। এর প্রকাশও তাই হয়ে থাকে বিভিন্ন রকম রকম। যেমন: মানুষ কেন্দ্রিক যে ভালোবাসাটা, নারী – পুরুষের যে ভালোবাসাটা এই ভালোবাসাটা একটি পর্যায়ে ফেলা যাবে। আমরা আমাদের পিতামাতাকে ভালোবাসি। সেই ভালোবাসাটা এক রকমের। আমরা আমাদের বন্ধুদেরকে ভালোবাসি। সেই ভালোবাসাটা আবার এক ধরনের। মানুষ তার পোষা প্রাণীকে ভালোবাসে। সেটা এক ধরনের ভালোবাসা। কেউ তার নিজের কাজগুলোকে খুব ভালোবাসে। সেটা আবার এক ধরনের ভালোবাসা।

ভালোবাসা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে হতে পারে, বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে হতে পারে। এক্ষেত্রে ভালোবাসার প্রকাশটাও বিভিন্ন রকমের হবে।

আমার প্রেমিকার প্রতি আমার যে ভালোবাসার প্রকাশ হবে, আমার পিতামাতার প্রতি আমার যে ভালোবাসার প্রকাশ হবে, আমার বন্ধুবান্ধবের প্রতি আমার ভালোবাসার যে প্রকাশ হবে সবগুলো ভালোবাসার প্রকাশ কিন্তু একই রকমের হবেনা। তাই আমি মনে করি ভালোবাসাটা শুধুমাত্রই নারী – পুরুষের ভালোবাসা নয়।

ভালোবাসা বিভিন্ন ভাবে হতে পারে। আমার প্রিয় লেখক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, আমার প্রিয় গায়ক যদি কষ্ট পায়, দুঃখ পায় তখন আমারও কষ্ট লাগে। হয়তো’বা তারা কেউ আমাকে চেনেন না, কখনো বা চিনবেন ও না।… তবুও কেন আমার কষ্ট হয়? কেন আমি তাকে ভালোবাসি? কারণ, তাদের কাজ, তাদের গান, তাদের লেখা আমার ভালো লাগে। তাদের কাজ আমাকে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় দিয়েছে এবং দিচ্ছে। আমার সুখে-দুঃখে, আমার সময়ে-অসময়ে আমাকে আনন্দ দিয়েছে, আমাকে স্থির রেখেছে।

যারা প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসতে জানেন, যারা ভালোবাসা বোঝেন তারা কখনো কারো বাহ্যিক রূপ দেখে ভালোবাসেন না। যদি তা করেন তাহলে বুঝতে হবে সেটা ভালোবাসা ছিল না, ভালোলাগা ছিলো, মোহ ছিলো, ক্ষনিকের আবেগ ছিলো, আকর্ষণ ছিলো। ভালোবাসা নয়।

ভালোবাসতে হলে মনকে চিনতে হয়, মনের গভীর থেকে অনুভব করতে হয়। কাউকে সারাজীবন না দেখেও তাকে ভালোবাসা যায়। যদি সেটা সত্যিকারের ভালোবাসা হয়ে থাকে তাহলে দূর থেকে ভালোবেসেও ভালো থাকা যায়। আর যদি সেটা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে না আসে তাহলে বুঝে নিতে হবে সেটা নিছক ই আবেগ, আকর্ষণ ছাড়া আর কিচ্ছু না। প্রেম, ভালোলাগা, মোহ, আকর্ষণ, আবেগ এসব কিছু বাহ্যিক অবস্থা, একমাত্র ভালোবাসা হলো মানসিক অবস্থা। যেটি সবাই অনুভব করতে পারেনা। তাই জীবনে ভালো থাকতে হলে, ভালোভাবে বাঁচতে হলে মনের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসা শিখতে হবে।

মোহ, আবেগ কিংবা আকর্ষণের মধ্যে সুখ হাতড়ে বেড়ালে কোনোদিনই প্রকৃত সুখের নাগাল পাওয়া যাবেনা। শুধুই পাওয়া যাবে ক্ষণিকের সুখ, স্থায়ী সুখ নয়।

আমি মনে করি, ভালোবাসায় দুটো পক্ষ জানতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। আমার কাছে ভালোবাসা একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি। সেই ব্যক্তিগত অনুভূতি আমাকে ভালো রাখে এবং রাখছে, আমাকে অনুভব করায়। সেটা যার বা যাদের প্রতি ভালোবাসা তিনি বা তারা জানলেন কি জানলেন না সেটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।

একটা ভালো জিনিসের প্রতি ভালোবাসা, ভালো কিছুর উপর টান এই টানটা মানুষকে অনেক বেশি ভালো রাখতে পারে বলে আমি মনে করি যদি সে সত্যিই ভালোবাসার আসল অর্থটি অনুধাবন করতে পারেন। ভালোবাসা একটি অসাধারন অনুভূতি, এর অপূর্ব শক্তি, এত অসাধারণ জিনিস পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই, সেটা যার প্রতিই ভালোবাসা হোক না কেনো।

এটিকে যদি মনে সত্যি সত্যি লালন করা যায় তাহলে জীবনে অনেক কিছু করা যায়। এটি আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আমি ব্যাক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি দুজন মানুষের শারিরীক সম্পর্ক থেকে বড় হচ্ছে ভালোবাসা। শারীরিক সম্পর্কে কাছে যেতে হয়, কিন্তু ভালোবাসা দূর থেকেও অনুভব করা যায়।

ভালোবাসা কখনো পাওয়ার দাবি রাখে না। ভালোবাসা সব সময় একটি মানসিক অবস্থা, আর প্রেম, রিলেশনশিপ এগুলো এক একটি বাহ্যিক অবস্থা। কাউকে না পেয়েও তার প্রতি ভালবাসাটা টিকে থাকে। আমার মতাদর্শ বলে আমরা যারা কাউকে ভালোবাসি, সবথেকে ভালো হয় তাকে না পেলেও নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে যাওয়া।

একটা মানুষের সাথে মায়ার সম্পর্কে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। সেখানে ভালোবাসা তৈরি নাও হতে পারে। ভালোবাসার মানুষকে জীবনে না পেলেও জীবন অপূর্ন থাকে না। জীবন আপন নিয়মেই চলে যাবে। ভালোবেসে না পাওয়া মানেই তাই জীবন শেষ করে ফেলা নয়। বরঞ্চ, এ এক নতুন গল্প লেখার মত। সে গল্পের শেষটা অন্য কারো হাত ধরে, ভিন্ন পথে।

যখন কেউ আমাদের সাথে থাকতে চায় না, তাকে কি আটকে রাখা সম্ভব? মানুষ তো আর কুকুর না। কুকুরকেও আটকে রাখা যায়না। যে আমাদের সাথে থাকতে চায়না তাকে যেতে দেয়া উচিত। সে যদি কখনো ফিরে আসে সেটা পরে দেখা যাবে। ফিরে এলেও কিচ্ছু হবে না। তাকে আমি ভালোবাসি, সে আমাকে ভালোবাসেনা। তাকে কি করে জোর করে বলবো “আমাকে ভালোবাসো।” জোর করে কখনো কাউকে ভালোবাসানো যায়না। যদি সত্যিই আমি তাকে ভালোবাসি তাহলে তার মঙ্গল কামনা করতে হবে, তার ভালো চাইতে হবে।

যে মানুষটা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য কারো মোহে, অন্য কারো হাত ধরে তাকে অভিনন্দন জানান, তার জন্য শুভকামনা রাখুন এবং নিজেকে এমন ভাবে বাঁচিয়ে রাখুন নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করুন যাতে আজকে না হোক আজ থেকে পাঁচ- ছয় বছর পরে হলেও আপনাকে দেখে সে মানুষটা ভাবে জীবনের সবচাইতে বড় ভুলটা করেছি তোমার হাতটি ছেড়ে দিয়ে। এটির চাইতে মধুর কোনো প্রতিশোধ, এটার চাইতে মধুর কোন আনন্দ এই পৃথিবীতে নেই।

আমি একজনকে মনেপ্রাণে ভালোবাসি। এটা আমি নিজের মধ্যে লালন করি, আমি এটা নিজের মধ্যে অনুভব করি। এই বিষয়টা আমাকে আনন্দ দেয়, এই বিষয়টা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, এই বিষয়টা আমাকে ভালো কিছু করার জন্য সাহায্য করে।

আমি মনে করি, আমরা কেউ যদি কাউকে প্রকৃতপক্ষে ভালবাসতে জানি তবে আমরা একটা অপূর্ব অনুভুতির মধ্য দিয়ে বেচেঁ থাকতে পারবো, আমরা একটা অসাধারন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজেকে বেড়ে উঠতে দেখতে পারবো। এতে আমাদের মনের শক্তি বাড়বে, আর মনের শক্তি বাড়লে আমরা নিজেদের ভালো রাখতে পারবো, আমাদের আশেপাশের মানুষদেরকে ভালো রাখতে পারবো। আমাদের জীবনটা সুন্দর হবে।

আমার কাছে ভালোবাসার মানে এটাই। আর এভাবে করেই আজীবন বেচেঁ থাকুক এই পৃথিবীর প্রতিটি বৈধ ভালোবাসা।

দিনশেষে বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য। যে যেভাবে থাকতে পারে সে না হয় সেভাবেই ভালো থাকুক তার মত করে। কিছু মানুষ না হয় একটু এই নিয়ম নীতির বাইরে গিয়ে বেচেঁ থাকুক আজীবন এই পৃথিবীর বুকে।


লেখক : প্রান্তর কর্মকার
ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত দিনঃ