জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST): বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধানে


জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের নাম নিশ্চই মনে আছে? নাসার ১০ বিলিয়ন ডলারের স্পেস টেলিস্কোপ যা খুলে দিয়েছে মহাকাশকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ। হাবলের পরে মানুষের নির্মিত সবচেয়ে শক্তিশালি টেলিস্কোপ এটি।

এবার পৃথিবীর বাইরে প্রানের সন্ধানে বিজ্ঞানীরা দ্বারস্থ হচ্ছেন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের উপর। সম্প্রতি পৃথিবী থেকে ৩৯ আলোকবর্ষ দুরের ট্রাপিস্ট-১ (TRAPPIST-1) তারার গ্রহ মণ্ডলী পর্যবেক্ষন করেছে জেমস ওয়েব।

ট্রাপিস্ট-১ তারাকে কেন্দ্র করে ঘোরা মোট ৭ টি গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আর আশার বিষয় হল এই সাতটি গ্রহের তিনটি এই তারার বাসযোগ্য সীমার (Star’s Habitable Zone) মধ্যে থেকে পরিক্রমন করছে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST): বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধানে 1
কম্পিটার রেন্ডারিং করা ট্রাপিস্ট-১ সিস্টেমঃ ৭ টি পৃথিবীর আকারের গ্রহ তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা একটি তারাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ছবিঃ NASA/JPL-Caltech

Star’s Habitable Zone বা কোন তারার বাসযোগ্য সীমা বলতে আমরা বুঝি- তারাটি থেকে যে দূরত্বে থাকলে তারার চারপাশে ঘূর্নায়মান গ্রহগুলো প্রান ধারনের উপযোগী থাকবে সেই স্থানটুকুকে। প্রতিটি তারার জন্য এই বাসযোগ্য সীমা আলাদা আলাদা হয়।

পৃথিবীতে আমরা সূর্যের বাসযোগ্য সীমার মধ্যে আছি। আমাদের নিকটতম মঙ্গল গ্রহও তাই। তারমানে শুধু বাসযোগ্য সীমার মধ্যে থাকলেই হবে না। প্রান ধারন করার জন্য একটা গ্রহকে আরো অনেকগুলো শর্ত পূরন করতে হয়।

ট্রাপিস্ট-১ তারার গ্রহগুলোতে কি ধরনের বায়ুমন্ডল আছে এবং তা প্রান ধারনের উপযোগী কিনা, বর্তমানে বিজ্ঞানীরা সেটাই খতিয়ে দেখছেন। ট্রাপিস্ট-১ এর গ্রহমণ্ডলী মুলত ২০১৭ সালেই ম্যাপিং করা হয় এবং জোতির্বিদদের একটা ধারনা দিতে সক্ষম হয় কিভাবে পৃথিবীর মত আকারের গ্রহগুলো তৈরি এবং তাতে প্রানের সঞ্চার হয়।

ট্রাপিস্ট-১ এর ৭ গ্রহের প্লানেটরি সিস্টেম গত জুন থেকেই পর্যবেক্ষন করে যাছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। যদিও প্রাপ্ত ডাটা সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয় মাত্র কিছুদুন আগে হয়ে যাওয়া এক সিম্পোজিয়ামে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST): বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধানে 2
ট্রাপিস্ট-১ এ মোট ৭ টি গ্রহ আছে। তার মধ্যে তিনটি TRAPPIST-1e, f এবং g হচ্ছে এর বাসযোগ্য সীমার মধ্যে। এগুলো সবুজ রঙে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তিনটি গ্রহের তাপমাত্রা তরল পানি থাকার উপযোগী। TRAPPIST-1b, c আর d তারাটির খুব কাছাকাছি রয়েছে এবং TRAPPIST-1h বাসযোগ্য সীমার অনেক বাইরে। নিচের চিত্রে ট্রাপিস্ট-১ এর সিস্টেমের সাথে সোলার সিস্টেমের তুলনা দেখানো হয়েছে।

b- থেকে শুরু করে- h পর্যন্ত ট্রাপিস্ট-১ এর গ্রহগুলোর নামকরন করা হয়েছে। b হচ্ছে তারাটির সবচেয়ে কাছের গ্রহ আর h হচ্ছে সব থেকে দূরের। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, ট্রাপিস্ট-১ তারাটি তূলনামূলক ভাবে ঠান্ডা আর নিষ্প্রভ একটি তারা। এর ৭ টি গ্রহ এর খুব কাছাকাছি দূরত্বে আছে। সৌরজগতের সাথে তুলনা করলে এরা সূর্য থেকে বুধ গ্রহের যে দূরত্ব সেই দূরত্বে আছে। বুধ (Mercury) সৌরজগতে সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ।

কোন তারার বায়ুমন্ডলে যদি কার্বন ডাই-অক্সাইড আর মিথেনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় তবে তা প্রান ধারনের জন্য সুখবর। আগের টেলিস্কোপগুলো দিয়ে ট্রাপিস্ট-১ এর গ্রহগুলোতে এই বায়ুমন্ডলের অস্তিত্ব পর্যবেক্ষন করা দুঃসাধ্য ছিল।

কোন গ্রহ যখন তার তারার সামনে দিয়ে পরিক্রমন করে, তখন এর থেকে বিকিরিত আলোক রশ্মির বর্নালী বিশ্লেষণ করে গ্রহটির বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে ধারনা করতে পারেন বিজ্ঞানীরা। ব্যাপারটি যদিও এতটা সাধারণ নয়, তবে মূলত এই পদ্ধতিতেই দূরবর্তী গ্রহ আর তারার গ্যসীয় অবস্থা যাচাই করা হয়।

ট্রাপিস্ট-১জি গ্রহ পর্যবেক্ষনের পর কানাডার মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জোতির্বিদ জন বেনেক জানিয়েছেন গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে হাইড্রোজেন এর আধিক্য নেই, তারমানে এর বায়ুমণ্ডলে আরো ভারী কার্বন ডাই-অক্সাইড বা অন্যকোন অনু আছে। অথবা এমনও হতে পারে এতে কোন বায়ুমন্ডলই নেই। ট্রাপিস্ট -১জি গ্রহটি পর্যেবেক্ষন করা সহজ ছিলো কারন এটি আকারে কিছুটা বড়।

বাকি গ্রহগুলো কিছূটা ছোট হওয়াতে এবং চৌম্বকীয় তরঙ্গের বাধার কারনে এদের বায়ুমন্ডলের ডাটা বিশ্লেষন করা শ্রমসাধ্য। তবে এখনই হাল ছেড়ে দেবার মত কিছু হয়নি।

ইউনিভার্সিটি অব মন্ট্রিলের আরেকজন জোতির্বিদ অলিভিয়া লিম, যিনি ট্রাপিস্ট-১ প্লানেটরি সিস্টেমের বাকি গ্রহগুলো পর্যবেক্ষন করছেন, তিনিও জন বেনেকের সাথে একমত হয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন ট্রাপিস্ট-১বি গ্রহটিতেও বায়ুমণ্ডল থাকতে পারে এবং তাতেও কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

যদিও এখনও তাদের হাতে নিশ্চিত করে বলার মত কোন তথ্য নেই। আরও পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষন তারা চালিয়ে যাবেন। তবে আশা করা যায় আগামী বছরের শেষের দিকে তারা ট্রাপিস্ট-১ প্লানেটরি সিস্টেম সম্পর্কে পৃথিবীবাসীকে আশার কথা শোনাতে পারবেন।

মতামত দিনঃ