ভূমিকম্প বা ভূমিকম্পন হলো পৃথিবীর ভূত্বকের (Crust) আকস্মিক কম্পন। এটি মূলত ভূতাত্ত্বিক কারণে ঘটে। ভূমিকম্প কেন হয়, তা সহজভাবে বোঝার জন্য নিচের প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো:

১. টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া (প্রধান কারণ)

পৃথিবীর উপরিভাগ বা ভূত্বক অখণ্ড কোনো পাথরের তৈরি নয়। এটি অনেকগুলো বিশাল বিশাল পাথরের খণ্ডে বিভক্ত, যেগুলোকে ‘টেকটোনিক প্লেট’ (Tectonic Plates) বলা হয়। এই প্লেটগুলো পৃথিবীর ভেতরের তরল ম্যাগমার ওপর ভাসমান অবস্থায় থাকে।

  • ঘর্ষণ ও ধাক্কা: এই প্লেটগুলো স্থির নয়, বরং খুব ধীর গতিতে নড়াচড়া করে। যখন দুটি প্লেট একে অপরের সাথে ধাক্কা খায়, দূরে সরে যায় বা একে অপরের গায়ে ঘষা লাগে, তখন সংযোগস্থলে (Fault Line) প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়।
  • শক্তির নির্গমন: যখন এই চাপ বা শক্তি মাটির নিচে পাথরের সহ্যসীমা অতিক্রম করে, তখন পাথরগুলো হঠাৎ ভেঙে যায় বা নড়ে যায়। এর ফলে জমে থাকা শক্তি সিসমিক ওয়েভ (Seismic Wave) বা কম্পন আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে তোলে। এটিই ভূমিকম্প।

২. আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত (Volcanic Eruption)

আগ্নেয়গিরি থেকে যখন লাভা বা গ্যাস প্রচণ্ড বেগে বের হওয়ার চেষ্টা করে, তখন আশেপাশের এলাকায় ভূমিকম্প হতে পারে। একে ‘আগ্নেয় ভূমিকম্প’ বলা হয়। তবে এগুলো সাধারণত টেকটোনিক ভূমিকম্পের মতো অতটা ধ্বংসাত্মক হয় না।

৩. ভূমিধস বা শিলাপতন

পার্বত্য এলাকায় বিশাল আকারের ভূমিধস বা পাহাড়ের বড় কোনো অংশ ধসে পড়লে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হতে পারে।

৪. মানুষের সৃষ্ট কারণ

প্রকৃতি ছাড়াও মানুষের কিছু কর্মকাণ্ডের কারণেও ভূমিকম্প হতে পারে:

  • পারমাণবিক বিস্ফোরণ: মাটির নিচে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালানো হলে কৃত্রিম ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।
  • বাঁধ নির্মাণ: বিশাল জলাধার বা ড্যাম তৈরির ফলে পানির প্রচণ্ড চাপে নিচের শিলাস্তরে ফাটল ধরে ভূমিকম্প হতে পারে।
  • খনি খনন: গভীর খনি থেকে কয়লা বা তেল উত্তোলনের ফলে মাটির নিচের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ভূমিকম্প হতে পারে।

সহজ উদাহরণ

মনে করুন, আপনি দুটি ইটের টুকরোকে একে অপরের সাথে খুব জোরে চেপে ধরে ঘষার চেষ্টা করছেন। প্রথমে এগুলো সরবে না, কিন্তু আপনি চাপ বাড়াতে থাকলে হঠাৎ করে একটি ঝটকা দিয়ে সরে যাবে। টেকটোনিক প্লেটগুলোর ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটিই ঘটে।

বাংলাদেশ কেন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে?

বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে একটি সক্রিয় ভূমিকম্প বলয়ে অবস্থিত। এর প্রধান কারণগুলো হলো:

  • প্লেট বাউন্ডারি: বাংলাদেশ মূলত ‘ইন্ডিয়ান প্লেট’ এবং ‘ইউরেশিয়ান প্লেট’-এর সংযোগস্থলের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। এছাড়াও মিয়ানমারের ‘বার্মা প্লেট’-এর প্রভাবও এখানে রয়েছে। এই প্লেটগুলোর ক্রমাগত নড়াচড়া ও ধাক্কার কারণে এখানে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
  • ফল্ট লাইন: বাংলাদেশের ভেতরে ও সীমান্তে বেশ কিছু সক্রিয় ‘ফল্ট লাইন’ (ফাটল) রয়েছে। যেমন—সিলেটের কাছে ‘ডাউকি ফল্ট’ এবং টাঙ্গাইল ও ঢাকার কাছাকাছি ‘মধুপুর ফল্ট’। এসব ফল্ট লাইন থেকে বড় মাত্রার শক্তি নির্গত হতে পারে।
  • ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা: ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুযায়ী বাংলাদেশকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট এবং চট্টগ্রাম সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ (Zone-1)। ঢাকা এবং টাঙ্গাইল মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ (Zone-2) এলাকায় পড়েছে।

বিশেষ করে ঢাকার অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং নরম মাটির কারণে এখানে ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা অনেক বেশি।

ভূমিকম্প কেন হয়? বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? 1
ভূমিকম্প কেন হয়? বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? 2
ভূমিকম্প কেন হয়? বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? 3
ভূমিকম্প কেন হয়? বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? 4

ভূমিকম্পের সময় করণীয় (নিরাপত্তা টিপস)

ভূমিকম্প হলে আতঙ্কিত না হয়ে মাথা ঠান্ডা রাখা সবচেয়ে জরুরি। পরিস্থিতি অনুযায়ী নিচের পদক্ষেপগুলো নিন:

যদি ঘরের ভেতরে থাকেন:

  • ডাক, কভার ও হোল্ড (Drop, Cover, and Hold on): মেঝতে বসে পড়ুন, কোনো শক্ত টেবিল বা খাটের নিচে আশ্রয় নিন এবং টেবিলের পায়া শক্ত করে ধরে রাখুন।
  • মাথা বাঁচান: টেবিল না থাকলে ঘরের কোণায় বসে হাত বা বালিশ দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢেকে রাখুন।
  • কাঁচ থেকে দূরে: জানালা, কাঁচের দরজা, আয়না বা আলমারি থেকে দূরে থাকুন যা ভেঙে গায়ের ওপর পড়তে পারে।
  • লিফট বা সিঁড়ি নয়: ভূমিকম্প চলাকালীন কখনোই লিফট বা সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করবেন না।

যদি ঘরের বাইরে থাকেন:

  • খোলা জায়গায় চলে যান।
  • বড় দালান, বৈদ্যুতিক খুঁটি, গাছ বা বিলবোর্ডের নিচে দাঁড়াবেন না।

ভূমিকম্প থেমে গেলে:

  • দ্রুত গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন চেক করুন। গ্যাসের গন্ধ পেলে আগুন জ্বালাবেন না।
  • খালি পায়ে হাঁটবেন না, কাঁচ বা ধ্বংসাবশেষ পায়ে ফুটতে পারে।

দুর্যোগের সময় দ্রুত ঘর ছাড়ার জন্য একটি ‘ইমার্জেন্সি কিট’ বা ‘Go Bag’ আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ। এই ব্যাগে এমন জিনিস থাকা উচিত যা আপনাকে অন্তত ৭২ ঘণ্টা (৩ দিন) টিকে থাকতে সাহায্য করবে।

ব্যাগটি অবশ্যই মজবুত, বহনযোগ্য এবং পানিরোধক (waterproof) হতে হবে। নিচে জরুরি জিনিসের একটি তালিকা দেওয়া হলো:

১. পানি ও শুকনো খাবার

  • পানি: জনপ্রতি অন্তত ২-৪ লিটার পানি।
  • খাবার: এমন খাবার যা পচে না এবং রান্না করতে হয় না। যেমন—বিস্কুট, চিড়া, মুড়ি, খেজুর, বাদাম, এনার্জি বার বা টিনজাত খাবার।

২. প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধ (First Aid)

  • কাটা-ছেঁড়ার জন্য ব্যান্ডেজ, তুলা, হেক্সিসল বা স্যাভলন।
  • জ্বর, পেট খারাপ ও ব্যথানাশক ওষুধ (প্যারাসিটামল, ওলাইন, এন্টাসিড)।
  • পরিবারের কারো নিয়মিত ওষুধ থাকলে (যেমন: প্রেশার, ডায়াবেটিস বা হার্টের ওষুধ) তার বাড়তি স্টক।

৩. আলো ও ইলেকট্রনিক্স

  • টর্চলাইট ও অতিরিক্ত ব্যাটারি: বিদ্যুৎ না থাকলে এটি জীবন বাঁচাতে পারে।
  • পাওয়ার ব্যাংক: মোবাইল চার্জ দেওয়ার জন্য ফুল চার্জ দেওয়া পাওয়ার ব্যাংক।
  • ছোট রেডিও: ইন্টারনেট না থাকলে খবর শোনার জন্য ব্যাটারিচালিত রেডিও।

৪. গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র

  • জাতীয় পরিচয়পত্র (NID), পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন এবং জমির দলিলের ফটোকপি।
  • এগুলো অবশ্যই একটি জিপলক ব্যাগ বা পলিথিনে মুড়িয়ে রাখবেন যাতে ভিজে না যায়।

৫. নিরাপত্তা ও অন্যান্য সরঞ্জাম

  • নগদ টাকা: এটিএম বুথ কাজ না করলে ছোট নোটের নগদ টাকা খুব কাজে লাগে।
  • বাঁশি (Whistle): ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়লে বা সাহায্যের জন্য শব্দ করতে এটি খুব কার্যকর।
  • মাস্ক ও স্যানিটাইজার: ধুলোবালি ও রোগজীবাণু থেকে বাঁচতে।
  • ম্যাচ বা লাইটার: আগুন জ্বালানোর প্রয়োজনে।

৬. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও পোশাক

  • টিস্যু, সাবান, টুথব্রাশ ও পেস্ট।
  • নারীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন।
  • হালকা কিন্তু গরম কাপড় বা কম্বল (শীতকালের জন্য)।

টিপস:

ব্যাগটি ঘরের দরজার কাছে বা এমন জায়গায় রাখুন যেখানে সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যায়। এবং প্রতি ৬ মাস অন্তর খাবার ও ওষুধের মেয়াদ চেক করে পরিবর্তন করুন।