এই লেখাটা কয়েকদিন ধরে আমার ফেইসবুকের টাইমলাইনে ঘুরছিল। বেশ ভালো ছন্দ আছে কথাটার। কিছুটা শ্লেষাত্বক, কিছুটা সারকাজম আর কিছুটা হতাশা পূর্ন কথা।
এর আরেকটা ভার্সন যেটা খুব বেশি ভালো লাগেনি সেটা হল “মোল্লা-পুরোহিত” এর জায়গায় “মসজিদ-মন্দির“
“যদি বেঁচে যাও এবারের মতো
যদি কেটে যায় মৃত্যু ভয়,
জেনো বিজ্ঞান একা লড়েছিল
মন্দির মসজিদ নয়”
এই কথাগুলি নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক।
মানুষ নিজের বিশ্বাস থেকে সরে আসতে বা নিজের বিশ্বাসকে অপমানিত হতে দেখতে পছন্দ করে না। আর বিজ্ঞানকে সেই প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম ব্যবসায়ীরা প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সাধারনের মনে তাই ধর্মের ভয় দেখিয়ে বিজ্ঞানকে হেয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে সবসময়ই। এতে অবাক হবার কিছু নেই।
আমরা বিজ্ঞান মনষ্ক জাতি নই। আমরা পুরোপুরি ধার্মিকও নই। আমরা ধর্মটা মানি শুধু মাত্র নিজের প্রয়োজনে। আমাদের পেট ভরলেই আমরা ধর্মকে ছাড় দেই। ব্যবহার করি নিজের সুবিধা মতো।
এখন একটা মহামারী চলছে। এই সময় ধর্মীয় নেতাদের যে ভূমিকা থাকার কথা ছিল সেটা নাই। বরঞ্ছ, তারা উল্টোপাল্টা বক্তব্য দিয়ে পরিস্তিতি আরো বেশি ভয়াবহ করে তুলেছেন।
যেখানে বিজ্ঞান বলেছে ভাইরাস বড় জমায়েত থেকে বেশি ছড়ায় সেখানে তাদের সুর ছিল উল্টো। কিছু কিছু তো আরেক ধাপ এগিয়ে বিভিন্ন সায়েন্টিফিক সূত্র দেয়া শুরু করেছিল।
ধর্মের দোষ কি? যারা ধার্মিক তারা ধর্মের শিষ্টাচার পালন করেন, সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করেন। ধর্ম তাদের জীবনের অনেক বড় একটা অংশ। ধর্ম তাদের আত্মিক উন্নয়ন করে। এখানে ধর্মের কোন অপরাধ নেই। কাউকে আঘাত না দিয়ে নিজ নিজ ধর্ম পালনই ধর্মের স্বার্থকতা।
কিন্তু ধর্ম যাদের জীবিকা, তারা ধর্মকে ব্যবহার করতে চান মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রন করার মাধ্যমে। এই নিয়ন্ত্রন চলে যাবার ভয়েই তাদেরকে অযাচিতভাবে বিজ্ঞানের বিরোধিতা করতে হবে। বিজ্ঞানের কাঁধে চড়ে ধর্ম যে কত বড় বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে তা প্রমান করতে হবে।
অথচ দুইটা সম্পুর্ন ভিন্ন ধরনের আদর্শ। একটার মূল বিষয় হল ফিলোসফি, আত্মিক উন্নয়ন, কিভাবে ইহকাল চলবেন আর পরকালের হিসাব নিকাশ।
অপরদিকে, বিজ্ঞান হল ব্যাখ্যা। আশে পাশে যা দেখি, অনুভব করি তার ব্যখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে বিজ্ঞান। এই ব্যাখ্যা দিতে গেলেই প্রয়োজন পড়ে গবেষনা করার। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে নিত্য নতুন তথ্য। সভ্যতা একধাপ একধাপ করে এগিয়ে যায়।
যা কিছু এখন ব্যবহার করছেন কাপড় থেকে টয়লেট টিস্যু পর্যন্ত। বিজ্ঞান তা আবিষ্কার করেছে বা উতকর্ষ সাধন করেছে। অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের সুবিধা সবাই ভোগ করছে, কিন্তু স্বীকার করার বেলায় বেশিরভাগই নারাজ। বিজ্ঞান কারো একার অবদান নয়। এই প্রক্রিয়া চলমান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
আমরা যখন একটা মহামারীর মধ্যে পড়লাম, আমরা দেখলাম আমাদের সব থেকে বেশি দরকার ঔষুধ আর ডাক্তারের। কিন্তু সেটাই আমাদের পর্যাপ্ত নেই। কারন এই খাত অবহেলিত বছরের পর বছর।
শিক্ষা আর গবেষনা খাতে যে ব্যায় আমাদের তা নিতান্তই শিশুসুলভ। তাই এখান থেকে ভালো কিছু বেরিয়ে আসাটা অনেকটা আকাশকুসুম কল্পনা। তাহলে রোগে-শোকে আপনি কার কাছে দ্বারস্থ হবেন? কোথায় যেতে চান আপনি চিকিৎসার জন্য?
সেই শ্লেষ থেকেই মনে করিয়ে দেয়া – বিজ্ঞান লড়েছিল। এর দিকে পরেরবার বেঁচে থাকলে নজর দিও। মসজিদ -মন্দিরের জন্য কত টাকার বাজেট ছিল আর গবেষনা খাতে কত ছিল সেই কূটতর্কে যাব না। ২০১৯/২০ অর্থবছরের বাজেটের দিকে খেয়াল করলেই সেটা বুদ্ধিমান হিসেবে বুঝে যাবেন।
সোজা কথায় এই রকম বিপদে যে কাজে আসবে সেইদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
সৃষ্টিকর্তা কিন্তু ঐ মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায় বা প্যাগোডায় থাকেন না। এখন যে সব উপাসনালয় বন্ধ তাতে কি ধর্ম নষ্ট হয়ে গেছে? মানুষ কি নিজ নিজ গৃহে প্রার্থনা করছেন না?
গবেষনা করা, ডাক্তারি করা, টিকা দেয়া এইগুলা মন্দির বা মসজিদের কাজও নয়। এইখানে লড়াইটা তাই বিজ্ঞান বনাম মহামারীর। আসুন না কয়েকটা দিন নিজেদেরকে একে অপরের প্রতিপক্ষ না ভেবে হাতে হাত মিলিয়ে বিজ্ঞানের কথা শুনি। মানুষকে সচেতন করি। হয়ত অনেক মৃত্যু আমরা কমাতে পারব।
বিজ্ঞানীরা অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছেন একটা কার্যকরী ঔষুধ বা ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের জন্য। কারন এখানে ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করবেন না। ঐশ্বরিক কোন মায়াজালে আকাশ থেকে আমাদের জন্য সাহায্য আসবে না।
তো লড়ছেটা কে? … বিজ্ঞান, ডাক্তার… পুলিশ… মানুষ।
যদি ধর্ম আপনার মনে এইটুকু সাম্যের বোধ না এনে দিতে পারে যে অসুস্থ মাকে রাস্তায় ফেলে দেয়া যাবে না, মৃত ব্যাক্তির জন্য মসজিদের খাটিয়া দিতে হবে, সৎকারের জন্য কবরের জায়গা দিতে হবে, তবে সন্দেহ জাগে আপনি কোন ধরনের ধর্ম পালন করেন! এত এত মসজিদ আর মন্দির আপনাকে কি শিখিয়েছে?
নাকি ভাবছেন আপনি মরবেন না! অথবা মরার পরে এই সকল পাপাচার করেও আপনি স্বর্গে চলে যাবেন!
মধ্যযুগে ইউরোপে ডাইনী সন্দেহে চার্চ অনেক মানুষকে হত্যা করেছিল। সেকথা ভুলে যাবেন না। সেই বর্বরতা থেকে সভ্যতা অনেকদূর এসেছে।
এক সময় পৃথিবী ছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্র, বিজ্ঞান সেটাকে ভূল প্রমানিত করেছে।
কিন্তু তারপরেও এই বিংশ শতাব্দীতে এসে “FLAT EARTH SOCIETY” নামক সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। যারা বিশ্বাস করে পৃথিবী সমতল। বিজ্ঞান তাদেরকেও ভুল প্রমানিত করেছে। বিজ্ঞানের কাজই হল প্রগতির। ভুল থাকলে শুধরে দেয়া। যদি শোধরাতে না চান তবে কুয়ার ব্যাঙ্গ হয়েই থাকতে হবে।
বিজ্ঞান কিন্তু নিজের ভূলও অনবরত শোধরায়। তাইতো একটা গবেষনার পরই সেটার পিছনে উঠে পড়ে লাগে সবাই। তাতে কারো কোন আক্ষেপ নেই। কারন সব থেকে ভালোটা বের করে মানব কল্যানে লাগানোটাই বিজ্ঞানের মূল কাজ।