নিহিলিজম (Nihilism) শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Nihil‘ থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো ‘কিছুই না‘ বা ‘শূন্য‘। সহজ কথায়, নিহিলিজম হলো এমন একটি দার্শনিক মতবাদ যা বিশ্বাস করে যে জীবনের কোনো নিগূঢ় অর্থ, উদ্দেশ্য বা অন্তর্নিহিত মূল্য নেই।

অনেকের কাছে এটি একটি নেতিবাচক বা হতাশাজনক ধারণা মনে হতে পারে, কিন্তু দর্শনের ইতিহাসে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর চিন্তাধারা।

১. নিহিলিজমের মূল কথা কী?

নিহিলিজম মূলত প্রচলিত বিশ্বাস, নৈতিকতা এবং জীবনের তথাকথিত ‘মহৎ উদ্দেশ্য’গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একজন নিহিলিস্ট বা শূন্যবাদী মনে করেন:

জীবনের কোনো উদ্দেশ্য নেই: আমরা পৃথিবীতে কোনো বিশেষ মিশন নিয়ে আসিনি। আমাদের জন্ম এবং মৃত্যু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা মাত্র।

নৈতিকতা মানুষের তৈরি: ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য—এগুলো মহাজাগতিক কোনো সত্য নয়, বরং সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষের তৈরি করা নিয়ম।

সত্য আপেক্ষিক: পরম সত্য বা ‘Absolute Truth’ বলে কিছু নেই।

২. নিহিলিজমের প্রধান প্রকারভেদ

নিহিলিজমকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। এর প্রধান কয়েকটি ভাগ হলো:

অস্তিত্ববাদী নিহিলিজম (Existential Nihilism): এটি সবচেয়ে পরিচিত রূপ। এর মতে, মানব জীবনের কোনো বিশেষ অর্থ বা মূল্য নেই। মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে মানুষের অস্তিত্ব অর্থহীন।

নৈতিক নিহিলিজম (Moral Nihilism): এই মতবাদ অনুযায়ী, নৈতিকতা বা মোরালিটি বলে বাস্তবে কিছু নেই। কোনো কাজকেই বস্তুগতভাবে ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ বলা যায় না।

জ্ঞানতাত্ত্বিক নিহিলিজম (Epistemological Nihilism):
এটি মনে করে যে, কোনো কিছু নিশ্চিতভাবে জানা বা সত্য বলে প্রমাণ করা অসম্ভব। আমাদের সব জ্ঞানই আসলে ভ্রম হতে পারে।

৩. নিহিলিজম ও ফ্রেডরিখ নিৎসে (Friedrich Nietzsche)

নিহিলিজম নিয়ে কথা বললে যার নাম সবার আগে আসে, তিনি হলেন জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসে। তিনি নিহিলিজমকে আধুনিক সমাজের জন্য একটি বড় সংকট হিসেবে দেখেছিলেন।

“ঈশ্বর মৃত (God is dead)”

নিৎসের এই বিখ্যাত উক্তিটি নিহিলিজমের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, ইউরোপীয় সমাজ থেকে ধর্ম এবং পরম বিশ্বাসের ভিত্তি সরে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষের সামনে একটি বিশাল শূন্যতা বা ‘অর্থহীনতা’ তৈরি হবে। নিৎসে ভয় পেতেন যে, মানুষ যদি জীবনের অর্থ খুঁজে না পায়, তবে সে হতাশায় ডুবে যাবে এবং সমাজ ধ্বংসের দিকে যাবে।

তবে নিৎসে শুধু সমস্যাটি দেখিয়ে দেননি, তিনি সমাধানও চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পুরোনো মূল্যবোধ ভেঙে নতুন মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে। মানুষকে নিজেই তার জীবনের অর্থ সৃষ্টি করে নিতে হবে, যাকে তিনি ‘Übermensch‘ বা ‘অতিমানব‘ হওয়ার ধারণা বলেছিলেন।

৪. নিহিলিজম কি শুধুই হতাশার?

অনেকে মনে করেন নিহিলিজম মানেই বিষন্নতা বা আত্মহত্যা প্রবণতা। কিন্তু এর একটি ইতিবাচক দিকও আছে, যাকে বলা হয় ‘Optimistic Nihilism’ বা ‘ইতিবাচক শূন্যবাদ’।

ইতিবাচক শূন্যবাদের দর্শন: যদি জীবনের কোনো পূর্বনির্ধারিত অর্থ না থাকে, তার মানে আপনি স্বাধীন!

  • আপনাকে কোনো মহাজাগতিক নিয়ম মেনে চলতে হবে না।
  • আপনি নিজেই আপনার জীবনের অর্থ তৈরি করতে পারেন।
  • ভুল করার বা ব্যর্থ হওয়ার কোনো মহাজাগতিক চাপ নেই, কারণ দিনশেষে মহাবিশ্বের কাছে এসবের কোনো গুরুত্ব নেই।

এটি মানুষকে একধরনের অদ্ভুত মানসিক প্রশান্তি বা মুক্তি দিতে পারে। যেহেতু কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই আপনি যা ভালোবাসেন তা-ই মন দিয়ে করতে পারেন।

নিহিলিজম আমাদের শেখায় যে, মহাবিশ্ব আমাদের সুখ-দুঃখ নিয়ে উদাসীন। এটি শুনতে কঠোর মনে হতে পারে, কিন্তু এটি আমাদের মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনে।

জীবনের কোনো ধরাবাঁধা অর্থ নেই মানে এই নয় যে জীবন যাপন করা বৃথা। বরং, জীবন যেহেতু একটিই এবং এর কোনো নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্ট নেই, তাই নিজের মতো করে এই ক্ষুদ্র সময়টুকু উপভোগ করা এবং নিজের জন্য অর্থ খুঁজে নেওয়াই হলো বুদ্ধিমানের কাজ।