নিহিলিজম বা শূন্যবাদ যদি হয় “জীবনের কোনো অর্থ নেই” (সমস্যা), তবে অস্তিত্ববাদ এবং অ্যাবসার্ডিজম হলো সেই সমস্যার দুটি ভিন্ন সমাধান বা প্রতিক্রিয়া।

আসুন, এই দুটি দর্শনকে সহজভাবে বুঝি।


১. অস্তিত্ববাদ (Existentialism): “আমরাই অর্থ তৈরি করি”

অস্তিত্ববাদ নিহিলিজমের মূল কথাটি মেনে নেয়—হ্যাঁ, মহাবিশ্ব আমাদের কোনো নির্দিষ্ট অর্থ বা উদ্দেশ্য দিয়ে পাঠায়নি। কিন্তু অস্তিত্ববাদ এখানেই থেমে যায় না।

মূল ধারণা: অস্তিত্ববাদের বিখ্যাত উক্তি হলো: “Existence precedes essence” (সারাংশের পূর্বে অস্তিত্বের প্রস্তাব)।

এর মানে হলো, আপনি আগে পৃথিবীতে এসেছেন (অস্তিত্ব) এবং তারপর আপনার কাজের মাধ্যমে আপনি ঠিক করবেন আপনি কে হবেন (সারাৎসার)।

সহজ কথায়, একটি ছুরির জন্ম হয় একটি উদ্দেশ্য নিয়ে (কাটা), তাই তার ‘সারাৎসার’ তার ‘অস্তিত্বের’ আগে আসে। কিন্তু মানুষের কোনো পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য নেই। তাই আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন।

  • স্বাধীনতা (Freedom): যেহেতু কোনো নিয়ম বা উদ্দেশ্য ঠিক করা নেই, তাই আপনি কী হবেন তা বেছে নিতে আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন।
  • দায়িত্ব (Responsibility): এই স্বাধীনতার সাথে আসে দায়িত্ব। আপনি আপনার জীবনের অর্থের জন্য অন্য কাউকে (ঈশ্বর, সমাজ বা ভাগ্যকে) দোষ দিতে পারবেন না। আপনার জীবনের অর্থ খুঁজে বের করার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনার।

উদাহরণ: জীবন হলো একটি ফাঁকা ক্যানভাস। নিহিলিজম বলে, “এই ক্যানভাসে কোনো ছবি আঁকা নেই এবং আঁকার কোনো কারণও নেই।” অস্তিত্ববাদ বলে, “হ্যাঁ, ক্যানভাসটি ফাঁকা। চমৎকার! এখন আমি আমার পছন্দের রঙ দিয়ে আমার নিজের ছবিটি আঁকব।”

মূল প্রবক্তা: জ্যাঁ-পল সার্ত্র (Jean-Paul Sartre), সিমোন দ্য বোভোয়ার (Simone de Beauvoir)।


২. অ্যাবসার্ডিজম (Absurdism): “অর্থহীন জেনেও বিদ্রোহ”

অ্যাবসার্ডিজমও নিহিলিজমের সাথে একমত যে জীবন এবং মহাবিশ্ব চূড়ান্তভাবে অর্থহীন। কিন্তু এটি একটি নতুন দ্বন্দ্বের কথা বলে।

মূল ধারণা: “দ্য অ্যাবসার্ড” (The Absurd) বা ‘অযৌক্তিকতা’ হলো একটি দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বটি দুটি জিনিসের মধ্যে:
১. অর্থপূর্ণ জীবনের জন্য মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
২. এই আকাঙ্ক্ষার প্রতি মহাবিশ্বের সম্পূর্ণ নীরবতা বা উদাসীনতা।

আমরা অর্থ খুঁজি, কিন্তু মহাবিশ্ব কোনো উত্তর দেয় না। এই নীরবতার মুখোমুখি হওয়াই হলো ‘অ্যাবসার্ড’।

আলবেয়ার কামুর (Albert Camus) সমাধান: আলবেয়ার কামু ছিলেন এই দর্শনের প্রধান প্রবক্তা। তিনি বলেন, যখন আমরা এই ‘অ্যাবসার্ড’-এর মুখোমুখি হই, তখন আমাদের কাছে তিনটি পথ খোলা থাকে:

১. আত্মহত্যা (Suicide): জীবন অর্থহীন, তাই বেঁচে থাকার দরকার নেই। (কামু এটিকে ‘পলায়ন’ বলে বাতিল করেছেন)।
২. বিশ্বাসের আশ্রয় (Leap of Faith): কোনো ধর্ম বা উচ্চতর শক্তিতে বিশ্বাস করা যে একটি অর্থ আছে, যদিও তার প্রমাণ নেই। (কামু এটিকে ‘দার্শনিক আত্মহত্যা’ বলেছেন, কারণ আপনি যুক্তির পথ ছেড়ে দিচ্ছেন)।
৩. বিদ্রোহ (Rebellion): এটাই কামুর সমাধান। আপনি মেনে নিচ্ছেন যে জীবন অর্থহীন, কিন্তু আপনি এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন। আপনি আত্মহত্যাও করছেন না, আবার মিথ্যা আশাতেও বিশ্বাস করছেন না। আপনি এই অর্থহীনতাকে স্বীকার করেই জীবনকে পূর্ণ উদ্যমে যাপন করছেন।

উদাহরণ (সিসিফাসের উপকথা): কামুর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র সিসিফাস। সিসিফাসকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল যে তাকে সারাজীবন একটি বিশাল পাথর ঠেলে পাহাড়ের উপরে তুলতে হবে, কিন্তু চূড়ায় পৌঁছানোর আগেই পাথরটি আবার গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবে। এটি একটি অর্থহীন, অন্তহীন কাজ।

কামু বলেন, সিসিফাস ‘অ্যাবসার্ড’ পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। কিন্তু যখন সিসিফাস পাথরটি গড়িয়ে পড়ার পর আবার নিচে নামতে থাকেন, তখন তিনি তার ভাগ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। তিনি জানেন এই কাজের কোনো মানে নেই। কামু বলেন, “এই সচেতনতাই তার জয়।” তিনি তার অর্থহীন ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন কেবল বেঁচে থাকার মাধ্যমে।

“We must imagine Sisyphus happy.” (আমাদের অবশ্যই সিসিফাসকে সুখী কল্পনা করতে হবে।)

আসুন, এই তিনটি গভীর দর্শনকে একটি খুব সহজ উদাহরণ দিয়ে বুঝি।

ধরুন, জীবন হলো একটা বড়, ফাঁকা ঘর।


১. নিহিলিজম (শূন্যবাদ): “ঘরটা অর্থহীন”

  • কীভাবে দেখছে: আপনি এই ফাঁকা ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন এর কোনো আসবাবপত্র নেই, কোনো রঙ নেই, কিছুই নেই।
  • সিদ্ধান্ত: আপনি বললেন, “এই ঘরের কোনো মানে নেই। এখানে থাকার কোনো উদ্দেশ্য নেই।”
  • ফলাফল: আপনি হতাশ হয়ে ঘরের এক কোণে বসে পড়লেন অথবা ঘরটা থেকে বের হয়ে গেলেন।
  • মূল কথা: জীবন অর্থহীন।

২. অস্তিত্ববাদ (Existentialism): “আমি ঘরটা সাজাবো”

  • কীভাবে দেখছে: আপনি এই ফাঁকা ঘরে ঢুকলেন এবং দেখলেন এটা সম্পূর্ণ ফাঁকা।
  • সিদ্ধান্ত: আপনি বললেন, “চমৎকার! ঘরটা যেহেতু ফাঁকা, আমি আমার নিজের পছন্দমতো এটাকে সাজাতে পারব। আমি নিজেই ঠিক করব কোথায় সোফা রাখব আর কোন দেয়ালে কী রঙ করব।”
  • ফলাফল: আপনি নিজের হাতে ঘরটাকে সাজিয়ে আপনার জন্য ‘অর্থপূর্ণ’ করে তুললেন।
  • মূল কথা: জীবন অর্থহীন হতে পারে, কিন্তু আমি নিজেই এর অর্থ তৈরি করব।

৩. অ্যাবসার্ডিজম (Absurdism): “ফাঁকা ঘরেই মজা!”

  • কীভাবে দেখছে: আপনি ঘরে ঢুকলেন। আপনার মন চাইছে ঘরটার একটা সুন্দর মানে থাকুক (আপনি আশা করেছিলেন ঘরটা সাজানো থাকবে), কিন্তু আপনি দেখছেন ঘরটা একদম ফাঁকা।
  • সিদ্ধান্ত: আপনি বুঝতে পারলেন যে, আপনার ‘অর্থ’ খোঁজার ইচ্ছা এবং এই ‘অর্থহীন’ ঘরের বাস্তবতার মধ্যে একটা অদ্ভুত সংঘাত আছে। এই সংঘাতটাই হাস্যকর বা ‘অ্যাবসার্ড’।
  • ফলাফল: আপনি হাসলেন। আপনি বললেন, “কী অদ্ভুত ব্যাপার! আমি অর্থ খুঁজছি আর ঘরটা ফাঁকা। বেশ! এই অর্থহীনতা মেনে নিয়েই আমি এই ফাঁকা ঘরে আনন্দে থাকব। আমি হয়তো এই ফাঁকা ঘরের মধ্যেই নাচ-গান করব।”
  • মূল কথা: আমি জানি জীবন অর্থহীন, কিন্তু আমি এই অর্থহীনতাকে স্বীকার করেও জীবনকে ভালোবেসে যাব এবং এর বিরুদ্ধে একরকম বিদ্রোহ করে যাব।

এক লাইনে পার্থক্য:

  • নিহিলিজম: “অর্থ নেই, তাই সব শেষ।” (হতাশা)
  • অস্তিত্ববাদ: “অর্থ নেই, তাই আমি অর্থ বানাবো।” (সৃষ্টি)
  • অ্যাবসার্ডিজম: “অর্থ নেই, আর আমি অর্থ খুঁজছি—এইটাই মজা! আমি এই অর্থহীনতা জেনেই বাঁচব।” (বিদ্রোহ)