ওভারব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আছি আমি। সন্ধার সূর্যটা বহু আগেই বাড়ি ফিরে গেছে, রাস্তার সোডিয়াম হলুদ বাতিগুলোও জ্বলে উঠেছে আলোকময় নগরীকে আরেকটু আলোকিত করে দিতে। এই সময় বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে মানুষের, ফিরে যাওয়ার নিরব প্রতিযোগীতা যেন শুরু হয়ে যায়। ভীড় বাড়ে বাসে, এই যাত্রাবাড়ি, গুলিস্তান, মিরপুর, শ্যামলী, ডাক হাঁকায় কন্ট্রাক্টাররা। আর যাত্রিদের ফিরে যাবার আকুলতা দেখতে থাকি আমি।
মানুষের জীবনটা বড় বিচিত্র। দিন শেষে রাতে পরিবারের পিছুটান এড়াতে পারেনা মানুষ। অবাক লাগে মাঝে মাঝে এরকম পিছুটান। আমার পাশেও ভীড় বাড়ে, অস্থায়ী বাসিন্দারা ফিরতে শুরু করেছে আপন নীড়ে। শুধু আমিই ব্যস্ততার পাশ কাটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
হাতের জ্বলন্ত বেনসন এন্ড হেজেসটাও আপন মহিমায় উজ্বল হয়ে উঠছে। আমাদের পৃথিবীটাও হয়ত কোন জ্বলন্ত সিগারেট, প্রতি মুহুর্তেই ছোট হয়ে আসছে। আমার মত মধ্যবিত্ত বেকারের হাতে এ জিনিস বেমানান। তবুও আজকের দিনে একটু বিলাসিতা হতেই পারে। এইভাবেই প্রতিটি রাত কেটে যায় এই “আমি” টার। আমি অনন্ত।
প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম ভেঙে যায় অনন্তের। ভোরের শিশির ভেজা মাঠে পা ডুবিয়ে শীতল হওয়াকে আত্মসাৎ করা, নিস্তব্ধ প্রস্তরখন্ডের আড়ালে বসে নদীর কলতানকে আত্মস্থ করা আর নীরবে নিভৃতে পাখিদের কলরব মুখর ধ্বনিকে অনুভব করার মাঝেই কেটে যায় অনন্তর রাঙা সকাল। অতঃপর দিনের বাকিটা সময় কেটে যায় নানা আয়োজনে। ক্লাসের পর আবার টিউশনিতে যেতে হয়।
মধ্যবিত্তের সংসার; বাবা অবসর নিয়েছে অনেক দিন। সামান্য টাকায় সংসার প্রায় অচল। তবুও থমকে নেই অনন্ত। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছুটে চলেছে পরিবারের দু-মুঠো সুখের ভীড়ে। অনন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তার প্রখর মস্তিষ্কে পড়াশোনা এক অনবদ্য শক্তি। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের চাওয়া পাওয়াকে পূর্ণতা দিতে ছুটে চলেছে অনন্ত। বাবা-মায়ের স্বপ্নের প্রতিটি মুকুল ছুঁতে আপ্রাণ চেষ্টা তার।
বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। তবে সাধ্য কি সকলের থাকে? মাঝে মাঝে কিছু দেখা স্বপ্নকেও অদেখা স্বপ্নের ভীড়ে জমাট করে রাখতে হয়। কিছু স্বপ্ন পূর্ণতা পাওয়ার পথে থাকে কিছু ব্যাত্যয়। তেমনি দারিদ্র্যতা আঘাত হেনেছিল অনন্তের বাবা-মা ও অনন্তের স্বপ্নে। তবে এ স্বপ্ন অদেখা থাকলেও অনন্ত নতুন স্বপ্নের ভীড়ে নিজেকে তাড়া করছিল। দু’হাতে সামলাচ্ছে নিজেকে ও পরিবারের মানুষগুলোকে। তেমনি একদিন; টিউশনি করে সবেমাত্র নিজ কক্ষে প্রবেশ করল, এমন সময় বাড়ি থেকে মায়ের ফোন আসল…
মাঃ “খোকা, কবে আসবি তুই?”
অনন্তঃ “মা, এইতো শবে কদরের নামাজ পড়ার পর-ই রওনা দিবো ইনশাআল্লাহ।”
মাঃ “কি বলিস! সেটা তো আরো ৩ দিন পর।
অনন্তঃ “মা, তুমি চিন্তা করো না তো! আমি চলে আসবো ঈদের আগেই ।”
মাঃ “আচ্ছা ঠিক আছে। শোন খোকা,সাবধানে ফিরিস কিন্তু।”
অনন্তঃ “তুমি চিন্তা করো না মা।”
অনন্তের মুখে তখনও কিঞ্চিৎ নীরবতা। বাড়িতে যে আছে তার চিরনিবিড় ভালোবাসা। চার বছর বয়সী ছোট বোন মায়া। তার আধো গলায় ভাইয়া ডাকটা শুনলে জুড়িয়ে যায় অনন্তের মন। না বলা কষ্ট আর চোখের পানিও আড়ালে চলে যায় মায়ার হাসিমাখা মুখের অগোচরে। গতবার বাড়ি থেকে ফিরবার সময় মায়া বারংবার তার আধো সুরে বলেছিল, “ভাইয়া! আমার জন্য নতুন জামা আনবে তো?” অনন্ত তার হাতদুটো মায়ার নরম গালে ছুঁয়ে দিয়ে বলেছিল, “হ্যাঁ রে বোনু, তোর জন্য লাল টুকটুকে রঙের একটা জামা আনবো। সাথে মেহেদী আর চুড়ি। হাত রাঙিয়ে মেহেদী পরবি তুই।” মায়া তখন একরাশ মিষ্টি হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল অনন্তকে।
আজ যখন মা ঈদে বাড়ি যাবার কথা বলছিল; তখন অনন্তের তীক্ষ্ণ চোখের বারান্দায় মায়ার সেই হাসিটি ভেসে উঠছিল বারংবার। এটা ভাবার পরক্ষণেই অনন্তের মস্তিস্ক জুড়ে তীব্র ধোঁয়াশার সৃষ্টি হলো। বোনের জন্য জামা কিনবার মতো টাকা তার কাছে নেই। টিউশনি করিয়ে যা টাকা হয়েছে সেটা দিয়ে যথাসম্ভব পরিবারের সাথে দেখা করবার মতো ট্রেনের টিকেট কিনতে পারবে। তবে? বোনের লালা জামার যে আর কেনা হবে না। নাহ! একমাত্র বোন, তার চাওয়াতে পূর্ণতা আমায় দিতেই হবে। প্রাণপণ চেষ্টা চালালো।
সিনথিয়ার কাছে হাত পাততেও নারাজ হলো না। সিনথিয়া তার ভালোবাসার মানুষ। মনে মনে অনন্ত চিন্তা করে মেয়েটার কাছ থেকে হাত পেতে অনেক টাকা এনেছি। এখন টাকা চাইতে নিজেরও লজ্জা করে। আর যাই হোক, সিনথি নিশ্চয়ই আমাকে বুঝতে পারবে; একটা না একটা ব্যাবস্থা ও করবেই। টাকা ও ঠিকই দিলো।
এমনও দিন গিয়েছিল যেদিন ক্যাম্পাসে দুপুরের খাবারটুকুও জোটেনি। তীব্র ক্ষুধায় কাতর হয়েও অনন্ত হাসিমুখে মেনে নিয়েছিল মৃত্যুক্ষুধা।
দেরি না করে বেরিয়ে পরল বোনের জন্য লাল রঙের জামা আর মেহেদী কিনতে। হাতে মাত্র হাজার টাকা সম্বল। আর চোখ দুটো লাল জামার ভীড়ে হানা দিল। শপিংমলে খানিক ঘুরে বোনের জন্য একটা জামা কিনল। নিজের জন্য কিছু কিনল না।
অতঃপর গন্তব্য সদরঘাট। টার্মিনাল পৌঁছাতেই লঞ্চটা ছেড়ে দেয় দেয় অবস্থা। লঞ্চটা যে ধরতেই হবে। কাল যে ঈদ! যেভাবেই হোক বোনের কাছে জামাটা পৌঁছে দিতেই হবে। ফুসফুসের সমস্ত বাতাস খরচ করে শেষ পর্যন্ত কোনক্রমে ঢুকে গেল অনন্ত ডেকের ভীড়ের মাঝে। এ যেন এক ভীষন যুদ্ধ। লঞ্চের ডেকজুড়ে ঘরে ফেরা মানুষের ঢল, আর অনন্তের বুকচেরা হাহাকার। ভীড়ের ধাক্কায় নিজের ব্যাগ হারিয়ে ফেলেছে অনন্ত। তার লাল টুকটুক স্বপ্নটা ব্যাগের ভিতর।
ভীড় ঠেলে আবার যাত্রী ছাউনির দিকে আগানোর চেষ্টা করছে সে সাথে চোখ নিচের দিকে, ব্যাগ খুঁজছে; পেয়েও গেল। মানুষের পায়ের চাপে ভর্তা হয়ে গেছে, নিচু হয়ে তুলতে গিয়ে যাত্রীদের ধস্তাধস্তিতে নিচে পড়ে গেল, এত ধকল আর সইতে পারল না তার ক্লান্ত দেহ। একপাশে বোনের জন্য কেনা লাল জামাটা আর অপর পাশে অনন্তের নিথর দেহটা পড়ে রইল। অনন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল মায়ার লাল স্বপ্নটা আঁকড়ে রাখার। শেষ রক্ষা আর হয়নি। ভীড় কিছুটা ফাঁকা হয়ে আসছে এখন।
হার না মানা মধ্যবিও অনন্ত ঠিকই বাড়ি পৌঁছলো। তবে, নিথর দেহে, সাথে বোনের জন্য কেনা লাল জামাটাও। আর অনন্ত? নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছিল সাদা কফিনের চাদরে। মায়া অনন্ত’কে বারবার ডাকছিল “ভাইয়া! ও ভাইয়া”।
তাসফীর ইসলাম (ইমরান); জন্ম ১৬ই সেপেটেম্বর, ২০০১। বাংলাদেশ সার্ভে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।