যৌক্তিক ভ্রান্তি এবং সাধারন মতামত


এদেশের নয়, কিন্তু কোনভাবে বাংলাদেশকে চেনে, এরকম কাউকে যদি খুব চিন্তাভাবনার সুযোগ না দিয়ে জিজ্ঞেস করেন বাংলাদেশ কেমন, এর মানুষদের সম্পর্কে তোমার কি ধারনা? … খুব অবাক হয়ে শুনবেন এরা আসলে বাংলাদেশ নিয়ে কোনদিন চিন্তাভাবনাও করে না, আর করলেও সেটা আমাদের জন্য সুখকর কিছু নয়।

অথচ আমাদের দেশে চায়ের দোকানে দশ মিনিট বসলেই অতি বিজ্ঞ লোকজনকে দেখবেন দেশের গন্ডি ছাড়িয়েও তারা ভারত খারাপ, পাকিস্তান খারাপ, চায়না খারাপ, আমেরিকারা খারাপ, বৃটেন খারাপ, সবাই খারাপ, এমনকি দেশের সরকার ডাকাত, পুলিশ খারাপ, প্রশাসন চোর – সবই জেনে বসে আছে। অবস্থা দেখে মনে হয় সব খারাপের একটা বিশেষ চশমা আছে এদের কাছে যেটা পরলেই পৃথিবীর তাবৎ সমস্যা এবং তার উৎস জানা হয়ে যায়।

আমরা বাংলাদেশের জনসাধারন একটা চাপা ঘৃনা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, সেটার আচঁড় দিতে চাই সবাইকে। এই যে দেখেন আমি নিজেও এই লেখা লিখতে বসে শুধু বাঙ্গালীর খারাপটাই দেখলাম। আমাদের অনেক অনেক কৃতিত্ব আছে সেটা কিন্তু বলছি না।

বলছি না কারন, কিছু জিনিস আমাদের শোধরানো দরকার আর জানা দরকার অন্যভাবেও চিন্তা করা যায়। ঘৃনা না ছড়িয়েও যুক্তির আড়ালে ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায়। এই বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে আসলে ভালো লাগে না। কিন্তু নিজের ভেতরে একটা তীব্র যন্ত্রনা হয় যখন সোশাল মিডিয়ায় এ ধরনের স্বস্তা মন্তব্য আর মিথ্যা দেখি। ছোট থেকেই শুনে আসছি একটা সমাজ নষ্ট হয় খারাপদের জন্য নয়, বরঞ্চ যখন এর ভালোরা চুপ থাকে।

সেই চুপ আমাদের সবাই হয়ে আছে। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো লোকগুলো নানা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। কারো চাকুরির ভয়, কারো সম্মানের ভয়, যশ কমে যাওয়ার ভয় আর সব থেকে বড় ভয় জীবন নিয়ে সংশয়।

সাম্প্রতিক একটা ঘটনা উল্ল্যেখ করি, সংবাদে প্রকাশ পেল নাপা সিরাপ খেয়ে দুটো বাচ্চা মারা গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে। চটজলদি ঘটনা আমলে নিয়ে নাপা সিরাপের সেই ব্যাচ মার্কেট থেকে তুলে ফেলার সিদ্বান্ত নেয়া হল। জনগনকে বলে দেয়া হল আপাতত নাপা সিরাপের না খেতে। পুলিশ প্রশাসন তদন্তে নামল ঘটনা কি? দেশ জুড়ে একটা নাড়াচাড়া পড়ে গেল। কারন বেক্সিমকোর এই নাপা সারা দেশে চলে।

পুলিশ সুরাহা করার আগেই, একটা অংশ সিদ্বান্ত দিয়ে দিল বেক্সিমকোর খারাপ হওয়ার পক্ষে। দরবেশ বাবা একটা চোর, সে এই ধরনের কাজ করতেই পারে। দরবেশ বলতে আসলে এরা বোঝায় বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে। শুধু মাত্র সালমান এফ রহমান খারাপ এই ধারনা মাথায় নিয়েই এরা রায় দিয়ে দিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা বিষয় নিয়ে।

আমি বাজি ধরে বলতে পারি, যারা হুট করে সালমান এফ রহমানকে খারাপ বলে তাদের ৯০ ভাগই জীবনে এই ব্যাক্তিকে মুখোমুখি দেখেনি, তার বিনিয়োগ এবং কাজ কি নিয়ে তাও জানে না। লোকে বলে বলেই আমি জানি সে খারাপ। শুনে শুনে বিচার করার ক্ষমতা সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙ্গালীর একটা সহজাত প্রতিভা।

আগেই বলেছি এই বিষয়টা নিয়ে লিখতে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করছিলাম না, তাও মনের দায় থেকে লিখছি। কারন জানি লেখা আপনাদের পক্ষে না গেলে আমিও খারাপ।

পুলিশের তদন্তের পর কিন্তু ঘটনা উলটে গেল। বের হয়ে এল মায়ের পরকীয়ার কারনে দুই শিশু সন্তানকে সে বিষ খাইয়েছিল।

যৌক্তিক ভ্রান্তি এবং সাধারন মতামত 1

এর পরও কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় গিয়ে দেখতে পেলাম এই দল বলছে, পুলিশ টাকা খেয়ে ঘটনা অন্যদিকে নিয়ে গেছে। পুলিশ খারাপ, বেক্সিমকোর অনেক টাকা…।

ইংরেজীতে একটা কথা আছে “logical fallacy” – বাংলা করলে দাঁড়াবে যৌক্তিক ভুলভ্রান্তি। আমাদের এই আমজনতা সেটাতেই ভোগে। তাদের বাঁধাধরা কিছু যুক্তি থাকে, বড়লোক মানেই খারাপ, চোর; পুলিশ মানেই ঘুষখোর, সরকার মানেই শোষণকারী… ইত্যাদি।

ঐযে ফুটপাতে দখল করে যারা ব্যবসা করে এদের তুলে দিলেও সমস্যা, বলে গরীবের পেটে লাথি দিচ্ছে। আবার না তুলে দিলে বলে সরকার কোন কাজের না। আইন সবার জন্য সমান হওয়া দরকার ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি এই ৫০ বছরেও, এটা মনে হয় আমাদের বড় ব্যার্থতা গুলোর একটা। সেই আইন সমানভাবে যদি সবজায়গায় প্রয়োগ করা যেত তবে বেশ ভালো হোত।

তার আগে, সবার আগে, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আপনাকে আইন জানতে এবং মানতে হবে। আপনি যদি রাস্তার আইন মানতেন তবে জায়গায় জায়গায় শুধু ট্রাফিক বাতিতেই কাজ হয়ে যেত, এত এত সার্জেন্টদের ডিউটি দিতে হতনা।

আমরা আইন ভাঙ্গি আবার নিজেরাই অন্যদের সে জন্য দোষারোপ করি। ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করা বেআইনি সেটা জেনেও আপনি যখন ফুটপাত দখল করছেন তখন আপনি অপরাধ করছেন। কাকে চাঁদা দিলেন না দিলেন তাতে আপনার অবৈধ কাজ বৈধ হয়ে যাবে না।

লজিক্যাল ফ্যালাসি থেকে আপনাকে বের হয়ে আসতে হবে। কেউ বড়লোক হলেই খারাপ, অপরাধ সেই করেছে এটা মাথা থেকে বের করে দিতে হবে। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাই অপরাধ করে।

যুক্তি দিয়ে চিন্তা করুন কিন্তু কুযুক্তি দিয়ে নয়। নাপা ঔষধ সেদিন দেশে আরো অনেকেই খেয়েছে। যদি পুরো ব্যাচই খারাপ হয়ে থাকে তবে যুক্তি বলে এরকম মৃত্যুর খবর আরো পেতাম।

পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া না জেনে ঢালাওভাবে সকল তদন্তকেই নাটকের কাতারে ফেলে দেয়াটা ভুল। তার মানে যদি ঘটনার ফলাফল আপনার মতামতের পক্ষে না যায় তবে সব কিছুকেই নাটক বানিয়ে ফেলবেন?

ফেইসবুকে বসে গোয়েন্দাগিরি করাটা অনেক সোজা, যাকে কখনও দেখিনি তার নামে কুৎসা রটনা করাও সোজা। কিন্তু লজিক্যাল ফ্যালাসি বাদ দিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করাটা কষ্ট, লোকে বলে তাই আমিও বলি বড়লোক মানেই খারাপ – তার মানে এই কাজ সেই করেছে।

আসুন ভালোবাসা ছড়াই, ঘৃনা নয়। যে বিষয় নিয়ে আমার মতামত না দিলেই নয় সেটা থেকে নিজেকে দূরে রাখি। দেশের মাথাপিছু আয় আর ব্যাক্তির সত্যিকারের আয় যে এক নয় সেটা বোঝার মত বুদ্ধি ধারন করি। মন্ত্রীরা পলিটিক্যাল স্ট্যান্টবাজির জন্য নানা ধরনের কথা বলবেন, সেসবে কান না দেই।

যুক্তি যদি ব্যবহার করতেই হয় তবে চিন্তাভাবনা করে সেটা ব্যবহার করুন। কারো কথায় হটাত করে প্রভাবিত হয়ে যায় শুধুমাত্র বোকারা।

কেউ যদি আপনাকে বলে আখের রস খেলে জন্ডিস ভালো হবে, তবে তার থেকে দশ হাত দূরে থাকুন। জন্ডিস লিভারের সমস্যা, তার মানে হেপাটাইটিস A, B অথবা C হতে পারে। জন্ডিস নিজে কোন রোগ নয়, বরং রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়। আপনার লোহিত রক্ত কনিকার ভাঙ্গন কেন শুরু হয়েছে সেটা ক্ষতিয়ে দেখা দরকার। পর্যাপ্ত বিশ্রাম আর বাসায় তৈরি পুষ্টিকর খাবারে জন্ডিস এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।

হতে পারে আখের রস অন্য অনেক কারনে শরীরের জন্য ভালো তবে জন্ডিস ভালো হবার সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই। ডাক্তারের পরামর্শ নিন, কি খেতে পারবেন আর পারবেন না তার কাছ থেকে জেনে নিন। লজিক্যাল ফ্যালাসি থেকে বের হয়ে আসুন, আখের রস পরিমিত মাত্রায় ভালো হলেও তা জন্ডিস ভালো করার কোন প্রমান নেই।

আর ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় যেভাবে আখের রস বিক্রি হয় সেখান থেকে জন্ডিস ছড়ানো খুব সোজা।

কোন ঝাড়ফুঁকেই জন্ডিস নামানো বা ভালো হয় না। সেটাও যদি বিশ্বাস করে থাকেন তবে আমার এই দীর্ঘ লেখা আপনার জন্যই। যুক্তি ভালো কিন্তু কুযক্তি চিনতে পারাটা আরো বেশি ভালো।

একটা কথা মনে রাখবেন, ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দেয়া সোজা, প্রমান করা কঠিন।

মতামত দিনঃ