মহানগর ওয়েব সিরিজ রিভিউ


মহানগর ওয়েব সিরিজ রিভিউ
  • গল্প
  • অভিনয়
  • মিউজিক
  • সিনেমেটোগ্রাফী
4.4

এক রাতের থ্রিলার - অসাধারন এবং অসাধারন

ঢাকার একটা রাত, একটা থানা, একটা গাড়ি এক্সিডেন্ট আর একজন অসৎ পুলিশ অফিসার। থ্রিলারের শুরুটা এখান থেকে। কিন্তু ঘটনার মোড় ঘুরতে বেশি সময় নেয় না। কিভাবে একজন ক্ষমতাশালী ব্যাক্তির দূর্নীতি গ্রাস করতে চায় আইনের শাসন আর তার ফাঁক গলে ধূর্ততার সাথে কাজ করে যায় পুলিশ – এর সব কিছুই পাবেন এই ওয়েব সিরিজে।

আমাদের আশেপাশে এরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। স্থান, কাল, পাত্র-পাত্রী তাই খুব চেনা মনে হবে দর্শকের কাছে। ছোট ছোট আট খন্ডের সুতোর জালে আটকা পড়ে যাবেন মুহূর্তেই।

 

নামঃ মহানগর
প্রকাশকালঃ ২৫ জুন ২০২১
ভাষাঃ বাংলা
পরিচালকঃ আশফাক নিপুন
অভিনয়েঃ মোশাররফ করিম, জাকিয়া বারি মম, খায়রুল বাশার, মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, নাসির উদ্দিন খান, শাহেদ আলি, শ্যামল মওলা, নিশাত প্রিয়ম
অনলাইন প্লাটফর্মঃ হইচই

 

ওয়েব সিরিজ একটা গতানুগুতিক ধারা মেনেই চলছে, অন্তত গতবছর যেগুলো দেখেছিলাম। ওপার বাংলায় কিছু ভালো কাজ হলেও বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের হাহাকার আছে। সেই হাহাকার গুছাতে প্রথমে এল “তাকদীর” চঞ্চল তার অসাধারন অভিনয় দিয়ে আরেকবার তার জাত চিনিয়ে গেলেন। এরপর মনে হল না আমরাও পারি, এরকম সিরিজ আমাদের দেশীয় পরিবেশ আর গল্প নিয়ে হর হামেশাই করা যায়। কিন্তু কে বানাবে?

আমাদের অনেক মেধা সম্পন্ন পরিচালক আছেন, নাটকের বাইরে গিয়ে তাদের কাজ যদিও কম। আশফাক নিপুন এবার সেই বদনামটাও গুচিয়ে দিলেন। মহানগর ওয়েব সিরিজ মাত্রই দেখে শেষ করলাম। মাত্র একরাতের কিছু কিছু খুচরো গল্প কিভাবে একটা অসাধারন প্লট হয়ে উঠতে পারে, সেটা আশফাক নিপুন এর করা এই ওয়েব সিরিজ যারা না দেখবেন তারা বুঝতে পারবেন না।

মহানগর ওয়েব সিরিজের প্রথম সিজনে আটটি পর্ব রয়েছে। পরে আরো সিজন আসবে কিনা জানি না। পরিচালক একেকটা পর্বের একেকে নাম দিয়েছেনঃ ‘ঈশানের মেঘ’, ‘চিচিং ফাঁক’, ‘শাপে বর’, ‘গলার কাঁটা’, ‘অমাবস্যার চাঁদ’, ‘অন্ধের যষ্ঠি’, ‘গোড়ায় গলদ’ এবং ‘কিস্তিমাত’। আমি এই নামকরনের স্বার্থকতা খুঁজে পাইনি যদিও।

ওয়েব সিরিজ ভালো হয়েছে এটা আমি দেখেই বলছি, কিন্তু একদম নিখুঁত হয়েছে এটা কিন্তু বলা যাবে না। পুরো গল্প বলে দিলে স্পয়লার হয়ে যাবে। ঘটনা এরকম, একটা পার্টি থেকে ফেরার পথে ক্ষমতাশালী ইন্ড্রাস্টিয়ালিস্ট আলমগির চৌধুরীর ছেলে আফনান চৌধুরী তার গাড়ি দিয়ে একটা এক্সিডেন্ট করে। থানায় নিয়ে আসার পর পুলিশকে তার বাবা ঘুষ দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আসলেই কি সেটা সম্ভব হয়?

পুলিশের ওসি হারুনের চরিত্রে মোশাররফ করিম তার সহজাত অভিনয় করেছেন। প্রথমদিকে দর্শক ধরেই নেবে সে একজন পেটমোটা ঘুষখোর অফিসার, কিন্তু কেন কি কারনে সে সব কিছুতে প্যাঁচ লাগাচ্ছে সেটা শেষ পর্যন্ত না দেখলে দর্শক বুঝতে পারবে না।

কিছু ঘটনা কেন এসেছে সেটা যদিও পরিচালক পরিষ্কার করে দেখাননি এবং অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় বলেও মনে হয়েছে যেমন, প্রথম দৃশ্যেই জয়নালকে ধরতে যাওয়া এবং তাকে পেয়েও ছেড়ে দেয়া এবং আবির আর তার বান্ধবীর গল্পগুলো অহেতুক দেখানো। হতে পারে ওসি হারুনের চরিত্রের বৈচিত্রময় দিক তুলে ধরতে আর থানায় কি হয় সেটা বোঝানোর জন্যই মূল ঘটনার বাইরে গিয়ে এইগুলো সিরিজে যুক্ত করা হয়েছে। তবে আমার মনে হয়েছে এগুলো না থাকলেও ওসি হারুনের চরিত্র যথেষ্ট ভালভাবে ফুটে উঠত।

মম কখনই মোশাররফ করিমের সমমানের অভিনেত্রী নন। তারপরেও তার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছু জায়গায় তাকে খুব দূর্বল মনে হয়েছে। মনে হয়েছে এসি’র চরিত্রে তিনি সাব-ইন্সপেক্টর মলয় এর উপর অনেক বেশী নির্ভরশীল, বিশেষ করে থানায় যখন মৃত ব্যক্তির কথিত স্ত্রীকে তিনি জেরা করতে চান।

ওয়েব সিরিজের আরেকটা বিষয় হচ্ছে এর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। বেশিরভাগ সময় এই পেছনের সংগীতের কারনে মূল ঘটনাতেই মনযোগ দেয়া যায় না। মহানগর সে দোষে দুষ্ট নয়। আশফাক নিপুনের মুন্সিয়ানা এখানে প্রশংসার দাবি রাখে। একটা বাড়িকে থানা বানিয়ে অভিনয় করতে গেলে অনেক ছোটখাট দিকে নজর রাখতে হয়। কোথায় চেয়ার বসবে, কোথায় টেবিল আর থানায় ডিউটিরতরা কিভাবে থাকে সেদিকেও নজর রাখতে হয়। সবকিছুই সেটাপ সহ, কালার গ্রেডিং আমার কাছে বেশ সময় আর যত্ন নিয়ে করা মনে হয়েছে।

কিছু ডায়লগতো বেশ মনে থাকবে, সাব-ইন্সপেক্টর মলয় যখন আবিরকে রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চার্জ করেঃ

মলয় : বাড়ি কই?
আবির : যশোর।
মলয় : যশোর কই?
আবির : মনিরামপুর।
মলয়: কোন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছেন।
আবির : এম এম কলেজ।
মলয় : আমিও তো এম এম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছি। কোন ব্যাচ?…….

এই যে পুলিশের সাথে এই মানবিক কথপোকথন এবং জেরা এটাই সাধারন। এটা ফুটিয়ে তুলতে নাটকিয়তা না করে পরিচালক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

মোশাররফ করিমকে যখন ডিবি ধরে নিয়ে যায় তখন সে মলয়কে বলে – “এই সিষ্টেমের কোনায় কোনায় কোনায় ভূত। ভূতদের ধরতে হলে মাঝে মধ্যে নিজের ও ভূত হওয়া লাগে। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে মাঝে মাঝে আঙুল টা বাঁকা করতে হয়।তুমি আঙুল ব্যাকা করাটাই দেখলা বাকি কিছু দেখলা না।”

কোন কিছুই নিখুঁত নয় পৃথিবীতে, তাই অহেতুক কথা না বাড়াই। একটা অসাধারন ওয়েব সিরিজ দেখলাম। আমাদের দেশের পটভূমিতে বাস্তব ঘটনার সাথে মিল রেখে যে অসাধারন থ্রিলার বানানো যায় “মহানগর” সেটারই প্রমান।

মতামত দিনঃ