|| এক ||
একদিন একটা সকাল ছিনতাই হয়েছিলো। আমি কিছু বলিনি। আশ্বিনের বাড়াবাড়িতে কিছুই বলা হয়নি। সেদিন আকাশের আকাশচুম্বী দাপাদাপির কোনো সীমা-পরিসীমা ছিলো না। বাতাসও নেংটি খুলে ইঁদুর দৌড়তে লাগলো । চেনা পথঘাট গুলো সব অচেনা হলো। হাঁটুজল আর কাদামাটির সেকি সরস সুখের দিন! এমনি দিনে বেলার বিয়ে। আড়ম্বরের কোথাও কোনো কমতি নেই। হলুদ বাটা, মেহেদি বাটা, পটকা ফুটা সবকিছু…..। প্রেমহীন বিয়ে। শরীরের না মনের তা ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানে না!
আমার ধারণা, সেইদিন যতো গুলো গরু, খাসি কুরবানি হয়েছিলো এরচেয়ে দুইটা বেশি ছিলো। একটা বেলা। আর একটা সকাল। বেলা সবেমাত্র ক্লাস এইটের চৌকাঠ পেরিয়েছে। নাইনের তাজা বাতাস এখনও তার গায়ে লাগেনি। বিয়ে কী জিনিশ ভালো করে বুঝেও না। এই বয়সে বুঝার কথাও নয়। ফুটন্ত গোলাপের পাঁপড়ির মতো তার গায়ের রঙ। শরীরের ভাঁজে সবে যৌবন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। যে বয়সে সবার মাঝে ঈশ্বর স্বয়ং প্রতিভাত হন; বেলার এখন সেই বয়স। ওর সমস্ত শরীরে যেনো অংকিত আছে একটা মোহময় স্বর্গীয় মায়াকানন।।
সেই মায়ামৃগের সন্ধান যে পেয়েছিলো; সেই আমাদের সকাল। ভোরের শ্রভ্রতার মতোই শান্ত-শিষ্ট, মিষ্টি অবয়ব। তুখোড় মেধাবী মুখ। পরিচ্ছন্ন আচরণে দশ গেরামে তার জুড়ি মেলা দুষ্কর। কিছুটা মেয়েলি স্বভাবের অন্তর। বুক আর মুখ একসাথে চালাতে পারে না। বুক থেকে গলা অবধি এসেই কাঁটার মতো আটকে যায়। মুখ পর্যন্ত পৌছায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রৌদ্রকরোজ্জ্বল উঠোন মাড়ানো পাঁচ গাঁয়ের প্রথম পথিকৃৎ। অযত্নে লালিত সফেদা গাছের প্রথম ফলের মতো আলোকময়।
সকালের আরও একটি পরিচয় আছে। সে কবিতা লিখে।
কেউ জানে না, সেই বেলা এবং সেই সকাল একে অপরকে নিয়ে লক্ষ-কোটি স্বপ্ন দেখেছে। সাদা কাগজের পাতায় নয়, হৃদয়ের গহীনে একজন আরেকজনের ছবি এঁকে রেখেছে। সেই ছবি হৃদয়ের সমস্ত অর্ঘ্য দিয়ে সযত্নে বুকে আগলে রাখছে। কিন্তু বুক থেকে মুখ এই পর্যন্ত আনতে পারছে না।
|| দুই ||
আমিও একজন অদ্ভুত টাইপের মানুষ। কিছুটা হিমালয় হিমালয় গন্ধ করে। তবে আমি হিমালয়ের মতো বরফের পাঞ্জাবি পড়ি না। লুঙ্গি পড়তে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। রাত-বিরাতে ঘুরে বেড়ানোও আমার পছন্দের তালিকায় নেই। বড়জোর জামতলা থেকে তিনকোণা পুকুরপাড়। তাও আবার বিষন্ন বিকেলবেলা। এখন বাইরে বের হলেই একটা প্রচ্ছন্ন ভয় এসে গলা টিপে ধরে। দিনকাল আর আগের মতো নেই। অনেকাংশ বদলে গেছে। প্রাগৈতিহাসিক নাট্যকলা ফিরে আসতে শুরু করেছে।
তবে এরচেয়ে বড়ো কথা কালের চেয়ে মানুষ গুলো বদল গেছে অনেক অনেক বেশি। অবশ্য এ কথাও সত্যি যে, যে ভয় পায় না; সে মানুষ-ই নয়। জিন-পরী টাইপ কিছু একটা হবে। কেউ তাকে দেখে না, সে সবাইকে দেখে। তবুও কেউ কেউ আমাকে দরবেশ দরবেশ ঠাওরায়। আবার কারো কারো মতে, আমি একজন নিরেট ভণ্ড। তবে গাছ থেকে তাল পড়ার মতো দুই একটা কথা হঠাৎ জায়গা মতো লেগে যায়। যদিও এটা যে কারুরই লেগে যেতে পারে।
যাক, এসব পঁচাবাসি কথা। সেদিন বেলার বিয়েতে আমিও ছিলাম। কথা বাড়িয়ে বলা অথবা আগবাড়িয়ে বলা মানুষের এক প্রকার স্বভাব। আমি নিজেও সেসব দোষে কিছুটা হলেও দুষ্ট। সত্যি কথা বলতে কি, প্রকৃতির সেই রুদ্র রুপ আমি আজো ভুলতে পারিনি। একেবারে বদ্ধ পাগলের মতো অবস্থা। জ্ঞানহীন বৃষ্টি আর অবুঝ বাতাসের সেকি ভুতুড়ে সেক্স। এরচেয়ে অদ্ভুত কথা, এতো যে বৈরি আবহাওয়া, প্রতিকুল পরিবেশ, মান্দারের কাঁটার মতো প্রতিবেশ —তবুও বেলার বিয়ের কোনো আয়োজন আটকাতে থাকেনি। সকাল আর বেলার ভয়াবহ মুখ দর্শন শেষে আমিও চেয়েছিলাম রোজ কিয়ামতের মতো কিছু একটা হউক। অন্তত আজকের মতো বেলার বিয়েটা বন্ধ হোক। আমার দরবেশির নিকুচি করি। হিমালয়কে পাগলা কুত্তা একশো একবার কামড় দিক। আকাশ থেকে বড়ো বড়ো বরফ পাহাড় পড়ে বিয়ে বাড়ি তামাদি হোক…তবুও আমি নিষপ্রাণ দুইটি দেহে প্রাণের সঞ্চার করার শেষ প্রচেষ্টা করে দেখতে চাই। বিধাতাকে বলি, আমাকে শধু একটা সুযোগ দাও। মাত্র একটা।
জীবনে কতো পাপ করেছি, মাছির চোখের মতো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আজ না হয় আরো একটি নতুন পাপের পালক পুরাতনের সাথে যুক্ত হবে। হউক। এ বিষয়ে আমার কোনো তদবির নেই। তুমি শুধু এই আশ্বিনা মহাপ্রলয়কে আরো একটু তাঁতিয়ে দাও। ওর জোড়া ডানায় আগুন জ্বালিয়ে দাও। সেই আগুনে এই বিয়ের সকল অনুষঙ্গ খড়কুটোর মতো ভেসে যাক।। যাক—-।।
|| তিন ||
অত:পর আমার সমস্ত দরবেশি মাটি হলো। হিমালয় নাম চুলোয় গেলো। ওরা কেউ থামলো না। না আশ্বিনা ঝড়। না বর পক্ষের আগমন। আর না কনে পক্ষের জোয়ার জল। তুমুল বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া যেনো লাঠালাঠির উষ্ণতা আরো বহুরুপী মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে। বাতাসের সাঁ সাঁ শব্দ গাছেদের পাতায় লেগে নতুন সুরের মুর্চছনা সৃষ্টি করেছে। সুরের এই ইন্দ্রজালের সাথে কাদাজলে লুটোপুটি খেয়ে লাটি খেলতে পারা এবং খেলা দেখতে পারা সবার ললাটে জোটে না। এখানে যেমন থ্রিল আছে, তেমনি আছে রোমাঞ্চ। বৃষ্টির সাথে সাথে আকাশ- বাতাস ওরাও চেটেপুটে খেয়ে নিচ্ছে স্বাদ। ভোগ আর উপভোগের এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে কোন্ হতচ্ছাড়া?
এই খেলায় আমরা তিনজন মাত্র পরাজিত। সকাল, বেলা আর আমি অধম। একটা আধা চালা ঘরের নিচে আধাআধি করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার অদুরেই সকাল। তার মাথার উপরে আকাশ-ই একমাত্র ছাদ। ভেন্না পাতাও নেই। এই আক্রোশ মুলক বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছেলেটা সাংঘাতিক রকম ঘামছে। সকল মানুষেরই সহ্যের একটা সীমা আছে। আমারও। চোখের ইশারায় সকালকে কাছে ডাকলাম। ও কিছু অপ্রস্তুত হলো। তবে থতমত খায়নি। আমি কোনো ভণিতা না করেই জিজ্ঞেস করলাম–
তুমি কি বেলাকে —– এই পর্যন্ত বলতেই সে উত্তর দিলো, জী আমি বেলাকে ভালোবাসি।
মনে মনে আমি সকালের আই কিউ’র প্রশংসা না করে পারলাম না। আবার বললাম, বেলা কি সেটা জানে?
– জী না। আমি ওকে সরাসরি কোনোদিন বলিনি।
ঃ এ আবার কেমন ভালোবাসা?
– কেনো কবিতার মতো। আমি তো কবিতাকেও কোনোদিন বলিনি তোমাকে ভালোবাসি। তবুও তো আমি তাকে ভালোবাসি। সব ভালোবাসা বলতে হয় না। হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। হৃদয়ে ধারণ করতে হয়।
আমি আরেকবার সকালকে মনে মনে সালাম দিলাম। পরিষ্কার আকাশের মতো তার স্পষ্টভাষিতা আমাকে বিমুগ্ধ করলো। তবুও আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ঃ বেলা কি তোমাকে….?
– জী, আমার ধারণা বেলাও আমাকে ভালোবাসে। যে মাটিতে আমাদের শরীর তৈরি সেই মাটির মতোই ভালোবাসে। সে কথা– ও আমাকে কয়েকদিন বলতে চেয়েছে। কিন্তু বুক ভেংগে মুখে আনতে পারিনি। তবে আমি ঠিকই বুঝে নিয়েছি। যেমনি করে বাতাসকে আমরা না দেখে বিশ্বাস করি তেমনি।
আমি কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার মাথায় সমস্ত আকাশ। তবুও ভালো পায়ের তলার মাটি এখনও সরে যায়নি। আমার নিজের কাছেই এখন সবকিছু খুব অবাক অবাক লাগছে। আসলে অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার চেনা যায় না। অন্ধকার চিনতে হয় আলো দিয়ে। সকাল তেমনি এক আলোর নাম। রাত্রির নপুংসক অন্ধকারকে আলোকিত করার জন্য-ই সকালদের জন্ম।।
আমার ভাবান্তর টের পেলাম। এই ভাবান্তরের মানে আমি জানি। এই ভাবান্তরের সাম্রাজ্যে আমি যদি ঠাস করে কিছু একটা মুখ ফসকে বলে ফেলি —–তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। যা বলবো ঠিক তাই ঘটবে। একচুল কমও না। একচুল বেশিও না। বাস্তবে কিছুই আমার মুখ দিয়ে বের হলো না। সকালকেও আর কিছু না বলে আমি দস্যু বৃষ্টির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম।
|| চার ||
হয়তো মহাবিশ্বের সীমানা আছে, কিন্তু মুর্খামির কোনো সীমানা নেই। এই কথাটি আমার না। কে বলেছে তাও এই মুহুর্তে মনে করতে পারছি না। তবে যে-ই বলুক না কেনো, কথাটা কিন্তু মন্দ না। আরো একটি বিষয় আছে, আমি খালি চোখে ঝাঁপসা দেখি না, চশমা পড়লেই ঝাঁপসা দেখি। আমি জানি, মুর্খদের এই দলে কে কে আছে, ইতিহাস সে কথা কোনোদিন ঘাটতে যাবে না। তবুও আমি বেলার সাথে এক চিমটি কথা না বলে থাকতে পারছি না। এখানেও সমস্যা কম না। পাড়ার মেয়েরা জোঁকের মতো ওর পেছনে লেগে আছে। তারা কেউ কোনোদিন নতুন বউ দেখেনি। বিয়ে দেখেনি। তাদের কারো কোনোদিন বিয়ে হয়নি।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পরিকল্পনা ঠিক করতে চাইলাম। মাথায় কিছু কাজ করছে না। কিন্তু অনবরত সংকেত পাঠাচ্ছে। বুঝতে পারলাম মাথা কাজ না করার মানে দুইটি। এক, সুযোগের অপেক্ষা করা। দুই, ঝুঁকি নেওয়া। নেকড়ের মতো শিকার ধরার জন্য ওত পেতে বসে থাকার মতো সময় আমার হাতে নেই। সুঁইয়ের মতন চিকন ছিদ্র দিয়েই আমাকে ঢুকতে হবে। অত:পর সুযোগ পেলে ফাল হয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্ধকারেরও আলাদা একটি রুপ আছে। সেই রুপ কয়জন দেখতে পারে?
হঠাৎ আমার শিয়াল দৌড়ের কথা মনে পড়লো। মানুষ দেখলেই সে লেজ গুটিয়ে ভোঁ দৌড় দেয়। সামনে- পেছনে তাকায় না। আমিও এমনি একটা দৌড় দিয়ে যে ঘরের মাঝখানে বেলা স্নায়ুর মতো বসে আছে, সেখানে গিয়ে পোঁছলাম। আমাকে দেখেই মুখরা রমণী দল সমানে শব্দ ও বাক্যবান ছুঁড়তে লাগলো। আমি একটাও ফিরানোর চিন্তা মাথায় ঠাই দিলাম না। বীরের মতো সদর্পে বললাম, বেলা তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। পেছন থেকে কে জানি বলল, কি কথা?
আমি মুখ না ঘুরিয়েই বললাম, যে কথার কোনো আগা মাথা নেই সেই কথা। বেলা পাথরের মুর্তির মতো আমাকে অনুসরণ করলো।
কিছুক্ষণ শামুক নীরবতা। কেউ কথা বলছি না। না আমি। না বেলা। বেলা পাখির ছানার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি–? একবার আকাশে যাই। আরেকবার যাই পাতালে। যেনো পৃথিবীতে আমি নাই। কথা বলি আর নাই বলি, আমি জানি দু’জনের হৃদয়েই এখন অশান্ত সাগরের ঢেউ। আমি স্বীকার করছি, এ আমার দুর্বলতা বই কিছু নয়। অবশেষে বেলা-ই প্রথম মুখের তালা খুললো। যেনো মাটির কাছে জানতে চাইলো, কিছু বলবেন ভাইয়া? আমিও চোখের পলক ফেলার আগেই পৃথিবীতে ফিরে আসলাম। গলার স্বর খাদের কিনারে নামিয়ে এনে বললাম, তুমি সকালকে চেনো?
– জী ভাইয়া চিনি।
ঃ কতোটা চেনো?
– কেজিতে বলবো নাকি সের দরে বলবো?
ঃ তোমার যা মর্জি হয়।
এরপর বেলা আর নিজে আটকে রাখতে পারেনি। কেটে দেওয়া বাঁধের জলের মতো হুড়মুড় করে ভেংগে পড়লো। এরপরের ঘটনাটি আরও আশ্চর্য, ধনুকে তীর দিতে যতোক্ষণ ঠিক ততোক্ষণ সময়ে সে নিজেকে ফিরে পেলো। কে বলবে এক বিজলি সময় আগেই এই মেয়ের চোখে জলপ্রপাত ছিলো। অত:পর কোনো রাখঢাক না করেই সে বললো,
– আপনি যা জানতে চেয়েছেন, আমি তা বুঝতে পেরেছি ভাইয়া। শুধু শুধু আপনাকে কষ্ট করে প্রশ্ন করতে হবে না। আমিই বলছি। শুনুন ভাইয়া, রাত যেমন সত্য, দিন যেমন সত্য; তেমনি সকাল আর আমার ভালোবাসাও সত্য। তবে সকাল আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলেনি অথবা আমিও সকালকে কিছু বলিনি। তবে আমাদের কোনো কথা হয়নি, দেখা হয়নি বিষয়টি এমনও নয়। নানা বাড়িতে অসংখ্যবার দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। আমাদের প্রতিটি সাক্ষাৎ কবিতার চেয়ে কম লাবণ্যময় নয়।
এতোটুকু বলেই বেলা থামলো। তার চোখে এক বিন্দু অশ্রু নেই। কেবল ভালোবাসা নিয়ে গৌরব আছে। হিমালয়ের মতো অহংকার আছে। ওদের কাছে হয়ত আমার ভালোবাসা শেখার আছে। মন তো সবারই আছে। কিন্তু এমন ভালোবাসার মন কয়জনের আছে? কেনো জানি আমার মনের ভেতরে খচখচ করছে। এ কেমন কথা, জমিতে ধান বপন করা হয়েছে। আগাছা পরিষ্কার করা হয়েছে। অতিশয় খাতির যত্ন করে এদের বড়ো করা হয়েছে; অথচ ফসল ঘরে তুলবে না! নবান্নের পিঠালির স্বাদ আস্বাদন করবে না? এসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে এখনো অধরা। তবে আশার কথা, আমার আগ্রহে এখনো ভাটা পড়েনি। বেলাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বললে না কেনো?
ভাইয়া, আপনি বুঝতে পারছেন না কেনো…বলার তো কিছু নেই। সকাল সব জানে। আমিও সব জানি। হৃদয়ের চেয়ে কি মুখ কোনোদিন বড়ো হয়?
মাত্র আটটি ক্লাস পাড়ি দেওয়া একটি পুঁচকে মেয়ের মুখে এসব কথা আমার বেমানান লাগছে। তাও হজম করা ছাড়া আমার অন্য উপায় কি? স্বেচ্ছায় যেই কাঁটা গিলছি; সেই কাঁটার বিষ আমাকেই সইতে হবে। আবার বললাম, এখন তাহলে কি হবে?
আমার প্রশ্ন শোনে বেলা যেনো সাত সমুদ্রের অতল থেকে ফিরে আসলো। অতঃপর জলদ গম্ভীর স্বরে বললো, এই বিয়ে আমি করবো না ভাইয়া। কিছুতেই করবো না।
বেলার কথা শুনে আমি আমার প্রিয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের সুর ভুলে গেলাম। তবে প্রায় নিবু নিবু আমার আশার প্রদীপটি যেনো হঠাৎ করেই জ্বলে উঠলো।। আমার মন আছে কি নেই, তা আমি সঠিক জানি না। তবুও মনে মনে বললাম, তাই যেনো হয়। তাই যেনো হয়।।
|| পাঁচ ||
আবারও বলি, যার মন নেই; তার আবার কি মনে হবে? তবুও মাঝে মাঝে অনুভবের শিকল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। পাড়ভাঙা নদীর মতো সেও টাচলাইন ছুঁয়ে দিতে চায়। কবিতার মতো কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চায়। চরম পুলক সুখানুভূতি অনুভব করতে চায়। কিন্তু চীনের মহাপ্রাচীরের মতো বাঁধার পাহাড় ডিঙোতে পারে না। তবুও মাকড়শার মতো স্বপ্নের জাল বুনতেই থাকে। শেষ হয় না।
সকালদের কথা বলছিলাম। ঝড়-বৃষ্টির মাতম একটুও থামেনি। অবশ্য এতে কারো আসা আটকে থাকেনি। শুভ কাজের গন্ধ পেয়ে কাজি সাহেব আগেই এসে হাজির হয়েছেন। তাঁব হাতে মোটা পলিথিনে মোড়ানো বিশাল সাইজের রেজেস্ট্রি খাতা। হয়ত এতে বেলার মতো এমনি কতো কিশোরীর অব্যক্ত কান্নার ছবি আঁকা। বেলার হবু বরকে দেখলাম। মেঘে ঢাকা মধ্যাহ্নের সুর্য। তেজ নেই। প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই লিকলিকে যুবক। শরীরের তুলনায় মোটা উদর। হাতির মতো ছোট ছোট এক জোড়া কোটরাগত চোখ। তবে পাত্র হিসাবে সোনার টুকরা। কোনো যৌতুক নেয়নি। হাড় কিপ্টে বাবার একমাত্র সন্তান। তবুও——। বেলার বাবা-মা কে আমার কিছুই বলার নেই। এমন সোনার হরিণ কে হাতছাড়া করতে চাইবে?
বেলার কথাটি এখনো আমার কানে আসা-যাওয়া করছে। মেয়েটি হয়ত জানে না সে কতোটা শক্ত কথা বলেছে। তবুও এই কথার রশি ধরেই আমি এখনও তেলাপোকার মতো টিকে আছি। বলা যায়, অথৈ সাগরের মাঝখানেও উদ্ধারকারী জাহাজের মাস্তুল দেখতে পাচ্ছি। সকাল কী ভাবছে বুঝতে পারছি না। আমার কাছে মনে হয়, সে ভাবছে রাত আগে না দিন আগে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, সমস্যা যতো জটিল এর সমাধান ততোটা জটিল নাও হতে পারে। অনেক দামী জিনিষও অনেক সময় জলের দামে পাওয়া যায়। সকাল আবার আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ দেখে কিছুতেই বুঝার উপায় নেই যে, কিছুক্ষণ পরেই কুরবানি পর্ব আরম্ভ হবে।
একটা বিষয়ে আমার শংকা আছে। অন্ধকার কতোটা দ্রবীভূত হয়। আমি চাইছিলাম, যে করেই হোক আজকের এই অন্ধকারটা যতোটা সম্ভব কাব্যিক হউক। ছনমনে হউক। ভালোবাসার মহাকাব্য নিয়ে আমার নিজস্ব কোনো হাইপোথিসিস নেই। কেবল সরল-গরলের কিছু লেনাদেনা আছে। এইটুকু সম্বল নিয়েই সকালকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলবে সকাল?
– আমার তেমন কিছু বলার নেই। শুধু আপনার পরিচয় —–
ঃ আমার বলার মতো বড়ো কোনো পরিচয় নেই। ভবঘুরে টাইপ একজন মানুষ। অমানুষও বলতে পারো।
– আমি আসলে ওসব জানতে চাইনি। আপনি কোন্ পক্ষের মেহমান?
ঃ ও আচ্ছা। আমি বেলার দুরসম্পর্কের ভাই। দুই গ্রাম পরে আমাদের বাড়ি। লোকে বলে, আমাদের গ্রামে কোনো আলো নেই। ভালোবাসার আলো। এইদিক থেকে অবশ্য তুমি খুব সৌভাগ্যবান সকাল। অন্তত একজনের ভালোবাসা পেয়েছো। বলতে পারো এক জীবনে তেমনটা কয়জনে পায় সকাল?
– অন্য কোনোদিন হলে আমি আপনার এই কথার জবাব দিতাম। কেনো জানি আজ দিতে পারছি না। মন থেকে সাড়া পাচ্ছি না।
ঃ ঠিক আছে। বাদ দাও ওসব। পানি একদিকে না একদিকে গড়াবেই। বেলা কি তোমার আত্মীয়?
– জ্বী। ও আমার আপন খালাতো বোন। আমি ওর আপন খালাতো ভাই। বেলার জন্মের সময় খালা আর আমার মা আমাদের দু’জনের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। আমি যেমন সেটা জানি, তেমনি বেলাও সেটা জানে। এখন আমাদের মা-বাবারা সেটা ভুলে গেছেন। কিন্তু আমরা ভুলিনি। আমদের সকালবেলার স্বপ্ন্বের কথা আমরা ভুলতে পারিনি।
আমি আবারও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটা হোঁচট খেলাম। হঠাৎ আমার হিমালয় হিমালয় ভাবটা জাগ্রত হয়ে উঠলো। আমি ঠাস করে বলে ফেললাম, সকাল আজ বেলার বিয়েটা হবে না। হচ্ছে না। আমার এই কথায় কতোটা অন্তরের জোর ছিলো; সে কেবল আমি জানি। আমি ভূমিকম্পকে অবিশ্বাস করতে পারি; কিন্তু আমার এই কথাকে নয়!!
অথচ কী আশ্চর্য!! এমন অসম্ভব একটা কথা বলার পরও সকাল এতোটুকু চমকে উঠলো না। সন্ধ্যা তারার মতো মিটিমিটি হাসতে লাগলো। সেই হাসির এমনি রঙ যে, সে খুশি হলো নাকি অখুশি হলো আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার কথা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তবুও বলি বিয়ে হউক আর না হউক সকালের মুখের এই এক চিলতে হাসি আমার কাছে এই মুহুর্তে ত্রিভুবনের চেয়েও অনেক অনেক বেশি নামিদামি।
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ, সহযোগী অধ্যাপক, আনন্দ মোহন সরকারী কলেজ, ময়মনসিংহ।