মহিলাদের স্কিন প্রবলেম নিয়ে বলতে গেলে সবার আগে মুখের স্কিনের কথাই আসে৷ কারণ শরীর যেমন আবৃত থাকে, মুখ সেরকম আবৃত থাকেনা৷ তাই বাইরের ধুলো ময়লাতে মুখের স্কিন ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি। ঘরোয়া প্রতিকারের মাধ্যমেই স্কিন প্রবলেম প্রতিহত করা সম্ভব।
নারী ঘরনি হোক বা ছাত্রী বা কর্মজীবি, হাজারটা ব্যস্ততা ঠেলে তাদের স্কিন কেয়ার করার সময় কই? দম ফেলারই ফুরসত নেই, সেখানে স্কিন কেয়ার তো বিলাসিতা মাত্র। নিজেকে ঠিকমত আয়নায় দেখার সময়টুকু পর্যন্ত পাওয়া যায় না।
উঠতি বয়সের কিশোরী এবং চাকুরিজীবী মহিলাদের জন্য স্কিন কেয়ার বেশ একটি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। স্ট্রেস, কাজের চাপ, পড়াশোনার চাপের কারণে তারা ত্বকের সমস্যায় তুলনামূলকভাবে বেশি ভোগেন। আবার গর্ভাবস্থায় পরিবর্তিত শরীর ও ত্বকের কারণে বেশিরভাগ নারীই হীনমন্যতায় ভোগেন।
স্কিনের সমস্যা দূর করতে সবসময় ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া লাগেনা। ঘরোয়া পদ্ধতিতেই স্কিন ঠিক রাখা সম্ভব। শুধুমাত্র তখনই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে যখন ঘরোয়া প্রতিকারেও কাজ হবেনা।
আজকের আর্টিকেলে আমি আলোচনা করব কিভাবে ঘরোয়াভাবে ত্বকের সমস্যা নির্মূল করা যায়। সাথে থাকছে ত্বক ঠিক রাখার কিছু টিপস।
তো আর দেরি কেন? চলুন জেনে নিই একের পর এক তথ্য।
মহিলাদের স্কিনে সবচেয়ে বেশি কোন সমস্যা দেখা দেয়?
মহিলাদের স্কিনের সবচাইতে কমন সমস্যা গুলো হচ্ছে –
• ব্রণ/অ্যাকনে
• মেছতা বা কালো দাগ
• রোদে পোড়া কালো দাগ
এই সমস্যাগুলো কিশোরী মেয়ে থেকে শুরু করে যেকোন বয়সের নারীরা সম্মুখীন হয়ে থাকেন।
স্কিনের সমস্যার পিছনে কোন বিষয়গুলো দায়ী
→অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা
→অস্বাস্থ্যকর খাবার
→অপর্যাপ্ত এবং অনিয়মিত স্কিন কেয়ার
→তাপমাত্রা
→গর্ভাবস্থা
→ইনফ্লামেটরি ডিজিস (যেমন ডায়াবেটিস)।
স্কিন প্রবলেমের জন্য ঘরোয়া প্রতিকার কি কি রয়েছে?
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত উপাদান দিয়ে আপনি খুব সহজেই আপনার স্কিন প্রবলেম ঠিক করতে পারবেন। চলুন দেখে নেয়া যাক কিভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে স্কিন ঠিক রাখতে পারবেন।
ব্রণের সমস্যা দূর করতে
ব্রণের সমস্যা দূর করতে পুদিনা পাতা, মূলতানি মাটি, অ্যালোভেরা অনেক বেশি কার্যকরী। আপনি পুদিনা পাতা দিয়ে কয়েক ভাবে স্কিন কেয়ার প্যাক বানাতে পারবেন।
পুদিনা পাতার পেস্ট বানাতে পারেন শুধু পানি দিয়ে। ১০-১৫টি তাজা পুদিনা পাতা বেঁটে তাতে সামান্য পানি মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিন। পেস্টটি ব্রণের জায়গায় লাগান, শুকিয়ে গেলে সাধারণ তাপমাত্রার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
চাইলে পানির বদলে গোলাপ জলও ব্যবহার করতে পারেন, তাতে বাড়তি সুবিধা পাবেন। পুদিনা পাতার সাথে পরিমাণমত গোলাপ জল মিশিয়ে পেস্ট করুন ও ব্রণের জায়গায় আলতো করে লাগান। ৩০ মিনিট পরে মুখ ধুয়ে ফেলুন। গোলাপ জলের ব্যবহার আপনার ত্বকে গোলাপী আভা ও লাবণ্য এনে দেবে।
আরেকভাবে পুদিনা পাতার ব্যবহার করতে পারেন। এক মুঠো তাজা পুদিনা পাতার সাথে এক টেবিল চামচ শসার রস এবং এক টেবিল চামচ টক দই মিশিয়ে পেস্ট করুন। খেয়াল রাখবেন টক দইটা যেন পানি ঝরানো হয়। এই পেস্টটা আপনি মুখের সাথে সাথে শরীরের ব্রণের জায়গায়ও লাগাতে পারবেন।
যেহেতু তৈলাক্ত ত্বক থেকেই ব্রণের উৎপাত, সেহেতু পুদিনা পাতা ও মূলতানি মাটির ফেসপ্যাক দিয়ে তেলতেলে ভাব এবং ব্রণ নির্মূল করুন সহজেই। ১০-১৫টি তাজা পুদিনা পাতা বেঁটে তার সাথে পরিমাণমত মূলতানি মাটি ও পানি মিশিয়ে লাগালে ভাল ফল পাবেন। চাইলে পানির বদলে সামান্য টক দই দিতে পারেন। পানি ঝরানো টক দই দিলে ত্বকের সেবাম ক্ষরণ বেশি হবেনা।
মূলতানি, লেবু, হলুদ, কাঁচা দুধ দিয়েও ফেসপ্যাক বানাতে পারেন। মিশ্রণটি বানাতে এক টেবিল চামচ মূলতানি মাটি, তিন/চার ফোঁটা লেবুর রস, এক টেবিল চামচ কাঁচা হলুদের রস, এক টেবিল চামচ কাঁচা দুধ নিন। সবগুলো একসাথে ভালভাবে মিশিয়ে মুখে ৮-১০ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। এই প্যাকটা সপ্তাহে একদিন লাগাতে হবে।
২ বা ৩ ইঞ্চি লম্বা একটি দারচিনির সাথে ৫টি লবঙ্গ এক টেবিল চামচ পানিতে মিশিয়ে বেঁটে নিন। এরপর এটি মুখে লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলুন। এই মিশ্রণটি সপ্তাহে তিনদিন ব্যবহার করতে হবে।
মুখের কালো দাগ দূর করতে
মুখের কালো দাগ বা কালচে ছোপ দূর করতে লেবুর রসের জুড়ি মেলা ভার। ডাক্তারি ট্রিটমেন্টের বদলে সহজে মুখের কালো দাগ দূর করতে চাইলে লেবুর বিকল্প নেই।
দাগের উপর সরাসরি লেবুর রস লাগাতে পারেন, সাথে কোন কিছু মেশানোর দরকার নেই। দাগের উপর লেবুর রস লাগিয়ে নিন, ১৫-২০ মিনিট পরে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। দিনে ২ বার এভাবে করুন, এক সপ্তাহ পর নিজেই পরিবর্তন টের পাবেন।
এক চা চামচ পাতিলেবুর রসের সাথে এক চা চামচ মধু মেশান। তারপরে এই মিশ্রণটি দাগের উপর আলতো করে লাগিয়ে নিন। ১৫-২০ মিনিট পরে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
এক চা চামচ পাতিলেবুর রসের সাথে এক চা চামচ টমেটোর রস মিশিয়ে দাগের অংশে ১৫ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন। এটাও দিনে ২ বার করলে ভাল ফল পাবেন।
রোদে পোড়া কালো দাগ দূর করতে
নিয়মিত লেবুর রসের ব্যবহার রোদে পোড়া দাগ দূর করবে সহজে। এছাড়া অ্যালোভেরা জেলের সাথে আলু থেতলে পেস্ট বানিয়ে পোড়া জায়গায় লাগাতে পারেন। আবার গুঁড়ো দুধের সাথে গ্লিসারিন মিশিয়ে তুলার সাহায্যে পোড়া জায়গায় মাসাজ করতে পারেন। আবার লেবুর রসের সাথে সামান্য ভিনেগার এবং অল্প পরিমাণে পানি মিশিয়ে ব্যবহার করলেও ভাল ফল পাবেন।
গর্ভাবস্থায় স্কিনের সমস্যা দূর করতে
গর্ভাবস্থায় স্কিনের সমস্যা খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এ সময় মুখের স্কিনে মেছতা, ব্রণ ইত্যাদির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত সন্তান জন্মের পরেই এগুলো নিমেষেই দূর হয়। তবুও যদি দূর না হয় তাহলে নিচের পদ্ধতিগুলো ট্রাই করুন।
বাইরে বেরোনোর সময় ভাল মানের এবং স্কিনের সাথে মানিয়ে যায় এমন সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। সাথে ছাতা নিতে ভুলবেন না যেন। এই সময়টায় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও বিশ্রাম হচ্ছে মেছতাকে মোকাবেলা করার কার্যকর পদ্ধতি। হালকা ধরণের ক্লিনজার দিয়ে ত্বক নিয়মিত পরিষ্কার করুন। ময়েশ্চারাইজার দিয়ে ত্বককে কোমল রাখুন।
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ব্রণের সমস্যা দূর করতে অ্যালোভেরা, ভিনেগার, এবং টি ট্রি অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। অ্যালোভেরা জেলের সাথে কয়েক ফোঁটা টি ট্রি অয়েল এবং অ্যাপল সিডার ভিনেগার মেশান। নিয়মিত এই মিশ্রণটি ত্বকে লাগান। মাঝে মাঝে পরিষ্কার কাপড়ের টুকরার ভিতরে বরফখন্ড মুড়ে ত্বকে ঘষতে পারেন। এভাবেও ব্রণ নির্মূল করা সম্ভব।
স্কিনের জন্য কোন প্রাকৃতিক উপাদান কতটা উপকারী
লেবুর রস
লেবুর রসে থাকা সাইট্রিক এসিড ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে এবং ত্বকের তৈলাক্তভাব দূর করে। লেবুর রস ত্বকের জন্য অদৃশ্য একটি রক্ষাকবচ।
মূলতানি মাটি
মূলতানি মাটি একদিকে যেমন ত্বকের অতিরিক্ত তেল শুষে নেয়, অন্যদিকে ত্বকের জীবাণুনাশক হিসেবেও কাজ করে। অতিরিক্ত তেল শুষে নেয়ার কারণে ত্বকে সহজে ধুলো ময়লা আটকানোর সুযোগ পায় না।
পুদিনা পাতা
পুদিনা পাতা ত্বকের আরেকটি জীবাণুনাশক। এটি গভীর থেকে জীবাণু নাশ করে, তাই সহজে অ্যাকনে বা ব্রণ তৈরি হওয়ার কোন চান্স নেই।
কাঁচা দুধ
কাঁচা দুধে থাকা ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বকের লোমকূপ পরিষ্কার করে ভালোভাবে। তাছাড়া ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য উপকারী সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
অ্যালোভেরা
অ্যালোভেরায় আছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরী উপাদান, যা ত্বকের ইনফেকশন দূর করে ব্রণ হওয়া থেকে অনেকাংশে রেহাই দেয়। তাছাড়া ব্রণের দাগ দূর করতেও অ্যালোভেরা দারুণ কাজ করে।
কিছু টিপস
শুধু ঘরোয়া পদ্ধতিতে স্কিনের সমস্যা দূর করার জন্য যথেষ্ট না। এখানে কিছু টিপস শেয়ার করলাম, যেগুলো আপনার স্কিন সবসময় ভাল রাখতে সহায়তা করবে –
★ সবসময় স্ট্রেসমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। স্ট্রেস ব্রণের সমস্যা প্রকট করে তোলে।
★ অতিরিক্ত তেল-মশলার বা ভাজাপোড়া খাবার একদম এড়িয়ে চলুন। সবজি খাবেন বেশি করে।
★ স্কিনের যত্ন নিন নিয়মিত। ভাল মানের ক্লিনজার, ময়েশ্চারাইজার, স্ক্রাবার, সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
★ মেকআপ সামগ্রী যত কম ব্যবহার করবেন ততই মঙ্গল। ব্যবহারের আগে মেয়াদ চেক করে নিতে ভুলবেন না।
★ প্রচুর পরিমাণে পানি পান করবেন এবং বিশ্রাম নিবেন। পানি রক্ত পরিষ্কার করার সবচাইতে সস্তা এবং নির্ভরযোগ্য উপাদান।
★ গর্ভাবস্থায় স্কিনের সমস্যা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবেন না। অতিরিক্ত চিন্তা করলে সেটা ত্বকের সাথে সাথে গর্ভস্থ বাচ্চারও ক্ষতির কারণ হবে।
★ যেসব খাবারে আপনার অ্যালার্জি হতে পারে সেসব খাবার এড়িয়ে চলুন। প্রসাধনীর ক্ষেত্রেও একই কাজ করুন।
★ কড়া রোদে বাইরে না যাওয়াই ভাল। গেলেও সানস্ক্রিন এবং ছাতা ব্যবহার করুন।
★ কখনোই ব্রণ নখ দিয়ে খুঁটবেন না। নখের আঁচড় পড়লে উল্টো আরো ক্ষতি হবে।
★ যদি আপনি ডায়াবেটিক পেশেন্ট হন, তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ডায়াবেটিসের কারণেও ত্বকে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।
★ সবশেষে বলব ডাক্তারি ট্রিটমেন্টের কথা। যদি দরকার হয় তাহলে ভাল ডার্মাটোলজিস্টের শরণাপন্ন হন এবং নিয়মিত ওষুধ খান।
এই ছিল ত্বকের যত্ন নিয়ে আজকের আয়োজন। আশা করি লেখাটি আপনাদের কাজে লাগবে। সবসময় সঠিক পরিচর্যা করবেন ত্বকের। আপনার একটুখানি সময় পারবে আপনার স্কিনকে হাজারো বিপদ থেকে দূরে রাখতে। কাজেই যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, ঘরোয়া পদ্ধতিতে যদি স্কিন ঠিক রাখতে পারেন, তবে আপনার গাঁটের পয়সাও বাঁচবে, আবার ডাক্তারি ঝক্কিও পোহাতে হবেনা।