এ লেখাটি যাঁরা পড়ছেন, সত্যি করে বলুন তো আপনাদের যৌনশিক্ষার ভিত্তি কি?
নিঃসংকোচে বলি, পারিবারিকভাবে আমি কোন যৌনশিক্ষা পাইনি।
অশিক্ষিত গৃহকর্মচারী, ইঁচড়ে পাকা স্কুলের বন্ধুবান্ধবের আনা কলকাতার এক বিখ্যাত(?!)লেখকের অশ্লীল বই, যায়যায়দিনের “প্রেমলীলা” অংশ এবং প্রেম সংখ্যা, এক আধবার এক টিকেটে দুই ছবি এবং রসালো আলোচনা- এই ছিল ছেলেবেলায় আমার যৌনশিক্ষার ভিত্তি।
বই পড়ার অভ্যাস ছিল, সেই সুবাদে বিদ্যুৎ মিত্রের লেখা(কাজী আনোয়ার হোসেনের ছদ্মনাম) একটা বই পড়েছিলাম। “যৌন বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান” নামের বইটি সেই সময়ের তুলনায় বৈপ্লবিক একটি কাজ হলেও তাতেও ছিল প্রচুর ভুলভাল তথ্য।তারপরেও, ওই বইটাই আমার চোখ খুলে দেয়। যৌনতাকে নোংরা, ক্লেদাক্ত, অছ্যুৎ একটা বিষয় না ভেবে অতি স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক একটা বিষয় হিসেবে দেখার শুরু ওই বইটির হাত ধরেই।
ইন্টারনেট আসার পরেও এই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। চটি বই আর এক
টিকেটে দুই ছবি প্রতিস্থাপিত হয়েছে পর্ন সাইট আর এমএমএসের মাধ্যমে।
প্রযুক্তি এগিয়ে গেলেও এগোয়নি মূল্যবোধ- তাই আগের চেয়ে অনেক সুদক্ষভাবে
ছেলেমেয়েদের মাথায় ঢুকছে অসুস্থ্য, বিকৃত চিন্তাভাবনা।
এর ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ। গোটা বাংলাদেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী ভুগছে যৌনবিকার
এবং মানসিক যৌন অক্ষমতায়। “বাংলাদেশী সিনড্রোম” নামে একটি মানসিক রোগের
কথাও মাঝেমধ্যে পেপারে পড়তাম।
প্রবাসে(এবং দেশে) থাকা অনেক বাংলাদেশী নতুন বিয়ে করার পর যৌন অক্ষমতায় ভুগতেন শুধু মানসিক কারণে। ছেলেবেলা থেকে ভুলভাল ধারণা নিয়ে বড় হওয়ার ফলে নবপরিনীতা স্ত্রীর উপর ওই ধারণা প্রয়োগ করতে গিয়েই ঘটত বিপত্তি। স্ত্রীরও যেহেতু যৌনশিক্ষা নেই, তিনিও আলোচনার মাধ্যমে বিপত্তি দূর করার বদলে হয় ভয়ে/লজ্জায় গুটিয়ে যেতেন অথবা এমনভাবে স্বামীকে অপমান করতেন যে বেচারার মৃত্যুর কাছাকাছি অনুভূতি হত।
যৌনতা যে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম নয়, এটি যে পরম আনন্দময়, মনোরম এবং প্রায় স্বর্গীয় একটি অভিজ্ঞতা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে অতি জরুরী একটি বিষয়- এই মৌলিক ধারণাটি খুব সম্ভবত শহর ও গ্রাম উভয়াঞ্চলের মানুষের ভেতরেই নেই।এর ফলে ভুক্তভোগীদের একটা অংশ সারাটা জীবন পার করে প্রাণহীন সম্পর্কের মধ্য দিয়ে, আর বাকিরা কি করে জানেন?
যারা চরিত্রবান তারা এই যন্ত্রণা মেনে নিয়ে মুখ গুঁজে সারাজীবন কাটিয়ে দেন, আর যাদের চরিত্র শক্ত নয় তাঁরা নিজেদের মত চাহিদা ‘এদিক সেদিক” থেকে মিটিয়ে নেন। অথচ, সুষ্ঠু যৌনশিক্ষা এই দুটি অগ্রহণযোগ্য সমাধানের চাইতে অনেক ভাল সমাধান দিতে পারত। সঠিক যৌনজ্ঞান থাকলে স্বামী বা স্ত্রীর সাময়িক সমস্যা নিজেরা নিজেরা অথবা চিকিৎসকের সহায়তায় ঠিক করে নেবার সুযোগ থাকত। যৌনতা আমাদের সমাজে ট্যাবু, অথচ ব্যাংকক শহরে যা হয় ঢাকার তার চাইতে কোন অংশে কম কিছু হয়না। শুধু শহরই বা বলি কেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও খুব বেশি পিছিয়ে নেই।
যৌন শিক্ষা না থাকার ফলে সম্পুর্ণ শারীরিক/মানসিক কারণে যৌন অক্ষমতায় ভোগা হতভাগ্য মানুষটিকে যেটুকু নয় তার চাইতে অনেক বেশি যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করা খোঁড়া মানুষটিকে আমরা সহানুভূতির দৃষ্টি দেই, আর যৌন সমস্যায় ভোগা মানুষটিকে সুযোগ পেলেই দেই নরক যন্ত্রণা।যন্ত্রণায় দগ্ধ মানুষটির যন্ত্রণাকে শতগুণে বাড়িয়ে দিতে না পারলে আমরা আর বাংলাদেশের মানুষ কেন?
যৌনতাকে ট্যাবু বা খারাপ কাজ হিসেবে দেখার ফলে সারাজীবন যে বিকৃতিটুকু মনের ভেতরে সৃষ্টি করে দেয় আমাদের সমাজ, তার দায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলে হতভাগ্য ভুক্তভোগীরা। অথচ ছেলেবেলার সঠিক যৌনশিক্ষা এই মানুষগুলোকে ছেলেবেলায় যৌন নির্যাতন থেকে বাঁচাতে রক্ষাই শুধু করত না, বড় হবার পরেও হয়তোবা নরক যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করত।
আমাদের করনীয় কি হতে পারে?
১) একদম বাচ্চা বয়েস থেকে স্কুলে ( ক্লাস ফাইভ হতে পারে) বাধ্যতামূলক যৌনশিক্ষা চালু করা, এর বায়োলজিকাল দিকগুলো শিশুদের উপযোগী করে পড়ানো। প্রচুর ভালো ভালো বই আছে এর উপর, সেগুলো আমাদের দেশের উপযোগী করে অনুবাদ করা যেতে পারে।
২) যৌনতা আর যৌনসন্ত্রাসের পার্থক্য, যৌন হয়রানি কি-কেন এটা খারাপ, এগুলো একেবারে কিশোর বয়েস থেকে সঠিকভাবে পড়ানো। সঠিক যৌনশিক্ষা শুধু যৌনতার বায়োলজিকাল দিক নয়, এর নৈতিক ও সামাজিক দিকটাকেও সঙ্গে নিয়ে কারিকুলাম আকারে বানানো যেতে পারে।
৩) পরিবার হচ্ছে সব শিক্ষার ভিত্তি- একটি শিশুর মনের ভেতরে যৌনতাকে ভয়াবহ, খারাপ এবং দোষের বিষয় হিসেবে না দেখিয়ে একে স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। একই সাথে এর নৈতিক দিক এবং সতর্কতামূলক আচরণগুলো বুঝিয়ে দিতে হবে।
৪) যৌন সমস্যা আর দশটা শারীরিক সমস্যা্র (যেমন সর্দি কাশি) মতই একটি সমস্যা, এটি নিয়ে আলাদা ভাবে লজ্জা পাবার কিছু নেই- এই ধারনাটি প্রচার করতে হবে।
পেশাগত ধারণা থেকে বলতে পারি, আমাদের সমাজে সঠিক যৌনশিক্ষা দেয়া হলে ম্যারিটাল রেইপ, শিশু নির্যাতন ইত্যাদি অপ্রকাশ্য অপরাধ তো বটেই, প্রকাশ্য যৌন অপরাধও বহুলাংশে কমে যেত।
শেষ করবার আগে একটা ডিসক্লেইমার দিয়ে নেই, অজাচার, উদ্দাম-উচ্ছৃংখল-অশালীন জাতীয় কোনকিছুকে এই পোস্টে উৎসাহ দেয়া হচ্ছেনা।
সবশেষে,যৌনতাকে যাঁরা ভয়ঙ্কর গোপনীয়, লজ্জাস্কর, অপরাধমূলক কোন কাজ ভেবে অন্ধকারে রাখতে চান তাঁদের প্রতি বিনীত প্রশ্ন, আমাদের দেশের জনসংখ্যা সতের কোটি হল কিভাবে??!!
লেখকঃ মাশরুফ হোসেন। বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত আছেন। তার চিন্তা চেতনা এবং সাবলীল লেখনীর জন্য অনেকেই তাকে সুপার কপ বলে থাকেন। লেখাটি সংগৃহীত, লেখকের অনুমতি নিয়ে জনস্বার্থে পুনরায় প্রকাশিত।