বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকুর – লড়াকু জীবন


বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকুর – লড়াকু জীবন 1
ছবিঃ সিএনবিসি

আমার কিছু কথা ছিল… বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু।

ভেঙে যাওয়ার সময়টা খেয়াল আছে আমার। আমাদের ভেঙে যাওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া। মা ফ্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, গোটা দৃশ্যটা আমার পরিস্কার মনে আছে। চোখের সামনে ভাসে।

তখন আমার ছয় বছর বয়স। স্কুল ব্রেকের সময় সাধারনত বাড়িতে খাবার জন্যে ফিরতাম। প্রতিদিন, একদম প্রতিদিন মেন্যুতে একই খাবার, পাউরুটি, দুধ। আসলে ঐ বয়সে খাবার নিয়ে কেউ চিন্তা করেনা। আসেনা মাথায়। মা যা দেয় বাচ্চারা খেয়ে ফেলে। তারপরও…তারপরও আমি জানতাম ওর চাইতে বেশি কিছু আমাদের সামর্থ্যের মধ্যেই ছিলো না।

তারপর আর কি, সেদিনটা আসলো। প্রতিদিনের মতো দুপুরে বাড়ি ফিরে সোজা ঢুকে গেলাম কিচেনে। দেখি মা রেফ্রিজারেটরের সামনে দাঁড়িয়ে, হাতে এক বক্স দুধ। আমার খুবই পরিচিত দৃশ্য। এই দৃশ্যে অপরিচিত যে অংশটা ছিলো তা হচ্ছে মা দুধে কি যেন মেশাচ্ছিলেন। খুব ভালো করে মেশাচ্ছিলেন, বুঝতে পারছেন তো? ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি কি হচ্ছে ঘটনাটা। ভালোমতো মিশিয়ে টিশিয়ে মা খাবার আমার সামনে এনে রাখলেন, মুখে সেই পরিচিত হাসিটা, যেন কিচ্ছু হয়নি। সবকিছু একেবারে ঠিকঠাক। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম। বুঝে যাচ্ছিলাম আসলে।

আমার মা দুধে জল মেশাচ্ছিলেন। গোটা সপ্তাহ চলার জন্যে আমাদের হাতে টাকা ছিলোনা। আমরা ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম, শুধু গরীব না, আমরা মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম।

আমার বাবা ছিলেন একজন পেশাদার ফুটবলার। ছিলেন ক্যারিয়ারের একদম শেষপ্রান্তে, খেলাও নেই টাকাও শেষ। এর প্রথম ধাক্কাটা গেলো আমাদের কেবল টিভির উপর দিয়ে। নো মোর ম্যাচ অফ দ্য ডে। নো সিগনাল।

এরপর বাড়ির ইলেকট্রিসিটি। এমনও সময় গেছে টানা দু তিন সপ্তাহ আমরা অন্ধকারে কাটিয়েছি। আমরা ডুবে যাচ্ছিলাম অন্ধকারে। নিকশ কালো অন্ধকার! রাতে বাড়িতে এসে দেখতাম গোটা বাড়ি প্যাঁচার মতো অন্ধকারে বসে আছে। স্নানের জন্যে গরম জল চাইলে আমার মা স্টোভে কেতলি চড়িয়ে দিতো। গরম জল হতো। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা কাপ দিয়ে মাথায় ঢালতাম সেই গরম জল।

এমনও সময় গিয়েছে, মা বাড়ির পাশের বেকারি থেকে পাউরুটি আনতেন বাকীতে। বেকারীর লোকজন আমাকে আর আমার ভাইকে চিনতো ঠিক করেই। ওরা আমার মা কে বাকীতে দিতো পাউরুটি। সোমবার বাকীতে নিয়ে শুক্রবার শুধে দিতে হতো।

জানতাম আমরা খুব একটা বিশ্রী সময় পার করছি, নিয়মিত যুদ্ধ করে আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু যখন মাকে দেখলাম দুধে জল মেশাতে, বুঝে গিয়েছিলাম সব শেষ। বুঝতে পারছেন তো? এই ছিলো আমাদের জীবন।

ঐদিন আমি মাকে কিচ্ছু বলিনি। মাকে কষ্ট দিতে চাইনি, বেচারিকে আর কত টানাপোড়েনে ফেলবো! চুপচাপ লাঞ্চ শেষ করে আবার স্কুলে চলে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন,সেদিন নিজের ভেতর খুব ভাঙাগড়া চললো। ঐ ছয় বছরের বাচ্চাটার ভেতর। মনে হচ্ছিলো হঠাত করেই কে যেন আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিয়েছে, এতদিন ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি কিভাবে যেন জেনে গেছি আমাকে কি করতে হবে। জানতাম কি করতে যাচ্ছি।

মাকে এভাবে বেঁচে থাকতে দেখা যায়না। সম্ভব না। আমি কোনভাবেই নিতে পারবো না।

ফুটবল নিয়ে যারা কথা বলে তারা খেলোয়াড়দের মানসিক শক্তি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। কে চাপে ভেঙে পড়েনা, কে কতো শক্ত মনের ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই হিসেবে যদি বলেন, আপনার দেখা ফুটবলারদের মধ্যে আমিই সবচে কঠিন মানসিক সামর্থ্যের মানুষ। আমার মনে পড়ে…অন্ধকার রুমের ভেতর আমার ভাই, মা আর আমি প্রার্থণা করছি…ভাবছি, বিশ্বাস করছি ,জানতাম এদিন বেশিদিন থাকবেনা। বদল আসবেই।

প্রতিজ্ঞাটা নিজের ভেতরেই রেখেছিলাম। প্রতিজ্ঞা্র কথা কাউকে বলতে হয়না তাই বলিনি। কিন্তু মাঝে মাঝে স্কুল থেকে এসে দেখতাম মা কাঁদছে। ভাল্লাগতো না। একদিন বলেই ফেললাম মা কে। “মা, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। দেখে নিও। আমি আন্দেরলেখটে খেলবো। খুব শিঘ্রীই খেলবো। আমাদের সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে এত কষ্ট করতে হবে না।”

আমার বয়স তখন ছয়। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “প্রফেশনাল ফুটবল কত বছর বয়স থেকে খেলা যায়?” বাবা বললেন, “ষোল বছর।” আমি বললাম,”আচ্ছা, তাহলে ষোলই সই।” হবে। হতেই হবে। শুধু সময়টার অপেক্ষা।

একটা কথা বলি-প্রতিটা ম্যাচ, প্রতিটা খেলা আমার জন্যে ফাইনাল। যখন পার্কে খেলেছি, ফাইনাল ছিলো। কিন্ডারগার্ডেনে ব্রেক টাইমে যখন খেলেছি-ফাইনাল ছিলো। আমি সিরিয়াস, ভয়ঙ্কর সিরিয়াস। যখনই বলে শট করেছি, চেষ্টা করেছি বলের কভারটা ছিঁড়ে ফেলতে। ফুল পাওয়ার। কোন ছেলেখেলা না, নো ফিটনেস শট। আমার কোন ফিফা ছিলো না। ছিলো না কোন প্লেস্টেশন। মাঠে আমি খেলে বেড়াইনি, খুনের নেশা নিয়ে বল পায়ে দাবড়ে বেরিয়েছি।

যখন লম্বা হতে শুরু করলাম, কয়েকজন শিক্ষক, অন্য বাচ্চাদের বাবা মায়েরা খুব ভড়কে যেতো দেখলে। একবার একজন জিজ্ঞাসাই করে বসলো, “এই ছেলে, তোমার বয়স কতো? জন্মেছো কোথায়?”

এই প্রশ্নটা আমি ভুলবো না কখনোই। আমার তখন চেহারায় লেখা, “হোয়াট? আর ইউ সিরিয়াস?”

আমার বয়স যখন ১১, লিয়ার্সে ইয়ুথ টিমে খেলছি। একদিন বিপক্ষ দলের এক খেলোয়াড়ের বাবা আমাকে আক্ষরিক অর্থেই মাঠে নামার সময় আটকে দিয়েছিলো। ভাবটা এমন যে, ”আরে এই ছোকড়ার বয়স কতো? এর আইডি কোথায়? এসেছে কোত্থেকে?” মনে মনে বললাম, “কোত্থেকে এসেছি? আচ্ছা? আমি এই অ্যান্টওয়ের্পেই জন্মেছি। এসেছি বেলজিয়াম থেকে।“

বাবা ওখানে ছিলেন না। দূরের খেলা গুলোতে আমি একাই যেতাম কারন আমাদের কোন গাড়ি নেই। একেবারে একা একটা ছেলে। আমাকেই দাঁড়াতে হয়েছে আমার জন্যে। আমার অবলম্বন হতে হয়েছে। ব্যাগ থেকে আইডি বের করে সোজা ঐ লোকের হাতে ধরিয়ে দিলাম। সবাই এক এক করে আমার আইডি দেখলো। পরিস্কার মনে আছে ওদের এই তীব্র অবিশ্বাসে আমার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছিলো। ঝড়ের বেগে মাথায় ভাবনা চলছে…আপনাদের ছেলেগুলোকে আমি ছিঁড়ে ফেলবো। একদম ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলবো, এমনভাবে ছিঁড়বো যাতে ধ্বংস হয়ে যায়। আপনাদের ছেলেরা আজ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যাবে…

আমি বেলজিয়ান ফুটবলের ইতিহাসের সেরা হতে চেয়েছি। ওটাই আমার লক্ষ্য। শুধু ভালো না, গ্রেইটও না, একদম সেরা। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে খেলতাম, এর কারণ অনেক…অনেক কারণ…কারণ আমার অ্যাপার্টমেন্টে ইঁদুর দৌড়ে বেড়ায়…কারন আমাদের মেঝেতে ঘুমোতে হয়…কারণ আমি চ্যাম্পিয়নস লীগ দেখতে পারি না…কারণ অন্যেরা আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন চিড়িয়াখানার কোন আজব জন্তু দেখছে…কারণ আমার মাকে আমার দুধের গ্লাসে জল মেশানোর কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়…বাকীতে পাউরুটি আনতে হয়…

যখন আমার বয়স ১২, ততদিনে ৩৪ ম্যাচে ৭৬টা গোল করে ফেলেছি। প্রতিটা গোল আমি করেছি বাবার জুতো পায়ে দিয়ে। আমার পা বাবার মাপের সমান হবার পর থেকেই আমরা একই জুতো শেয়ার করি। তো এর মাঝেই আমি একদিন দাদুকে ফোন করেছি। আমার মায়ের বাবা। ভদ্রলোক আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। কঙ্গোতে এই একটা মানুষের সাথেই আমার যোগাযোগ। কঙ্গোর সাথে এই একটাই আমার সম্পর্ক। আমার বাবা-মা কঙ্গো থেকেই এসেছিলেন। ফোনে দাদুকে বলছিলাম,” আমি খুব ভালো খেলছি দাদু। ৭৬ টা গোল করেছি। লীগ জিতেছি এবার। বড় দলগুলোর চোখ পড়েছে আমার উপর।“

সাধারণত দাদু আমার ফুটবল খেলা নিয়েই সবসময় জানতে চাইতো। খুব উৎসাহী ছিলেন মানুষটা। দাদু বললেন,” সাবাস রোম, সাবাস। আমার জন্যে একটা কাজ করতে পারবি তুই?”

– বাহ! পারবো না কেন? বলেই দেখো।

দাদু বললেন, “আমার মেয়েটাকে দেখে রাখতে পারবি, প্লিজ?”

পুরোপুরি কনফিউজড হয়ে গেলাম। আরে দাদু এসব কি বলছে? সমস্যা কি? বললাম, “মার কথা বলছো? আচ্ছা, ঠিক আছে। আমরা তো ভালোই আছি। উই আর ওকে।“

দাদু বললেন, “না ,প্রতিজ্ঞা করে বল। প্রতিজ্ঞা করতে পারবি? আমার মেয়েটাকে শুধু দেখে রাখিস। আমার হয়ে দেখে রাখিস কেমন?”

এর ঠিক পাঁচদিন পর আমার দাদুটা মরে গেলো। তখন বুঝলাম আসলে দাদু কি বলতে চেয়েছিলেন। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি। আর চারটা বছর বাঁচলে কি হতো? আর মাত্র চারটা বছর বাঁচলেই আমার দাদুটা দেখে যেতে পারতো আমি আন্দেরলেখটে খেলছি। দেখে যেতে পারতো আমি আমার প্রতিজ্ঞাটা রাখতে পেরেছি। দেখে যেতে পারতো তার মেয়েটা এখন ভালো আছে। সবকিছু ঠিকঠাক।

মাকে বলেছিলাম ১৬ বছরেই হয়ে যাবে। যদিও আমার দেরি হয়েছিলো। দেরি হয়েছিলো ঠিক ১১ দিন।

প্লে অফ ফাইনাল। আন্দেরলেখট বনাম স্ট্যান্ডার্ড লিগ। খুব এলোমেলো একটা দিন। মাতাল একটা দিন। সিজনের শুরুতে আন্দেরলেখটের আন্ডার নাইনটিন দলে আমি ছিলাম। ছিলাম বেঞ্চে। বেঞ্চ গরম করা ছাড়া কোন কাজ নেই। কোচ আমাকে মনে হয় সেজন্যেই রেখেছিলেন। খেলোয়াড়েরা এসে যাতে গরম বেঞ্চে বসতে পারে তাই বেঞ্চে বসে থাকবে রোম। আমার মনে হলো, “আরে আশ্চর্য তো! এভাবে বেঞ্চ লেপ্টে বসে থাকলে ষোলোর আগে আমি প্রফেশনাল কন্ট্যাক্ট সাইন করবো কিভাবে? হবে নাতো এভাবে”।

কোচের সাথে বাজি ধরে ফেললাম। কোচকে বললাম, “কোচ, শুনুন, আমাকে যদি খেলতে দেন ডিসেম্বরের মধ্যে আমি ২৫ টা গোল করবো। গ্যারান্টি।“ ব্যাটাচ্ছেলে হাসা শুরু করলো। হ্যাঁ, সত্যি খুব জোরে হাসা শুরু করলো। বললাম, “আচ্ছা ঠিক আছে যান। বাজী।” কোচ বললেন, “ওকে, কিন্তু যদি ডিসেম্বরের মধ্যে ২৫ টা গোল না করতে পারিস, আবার সোজা বেঞ্চে।” আমি বললাম, “ঠিক আছে। কিন্তু যদি আমি জিতে যাই, আমাদের আনা নেয়ার যে মিনিভ্যান আছে সেটা আপনাকে রেগুলার পরিস্কার করতে হবে।“

– “আচ্ছা ব্যাটা যা। ডীল।”

– “আরেকটা কথা। আপনি তাহলে প্রতিদিন আমাদের প্যানকেক বানিয়ে খাওয়াবেন।”

আমাদের কোচের জীবনে ওই ছিলো সবচে খারাপ বাজী। এরচেয়ে খারাপ বাজি সে তার ইহজন্মে ধরেছে বলে মনে হয় না। নভেম্বরের মধ্যেই ২৫ টা গোল হয়ে গেলো। ক্রিসমাসের আগেই আমাদের সবার হাতে প্যানকেক। আমরা সবাই ফ্রিতে প্যানকেক খাই ব্রো।

এটা একটা শিক্ষাও বলতে পারেন। যে ছেলেটা খেতে পায় না, খুব খিদে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে তার সাথে মশকরা করা ঠিক না। ঘটি বাটি উড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

আন্দেরলেখটের সাথে আমি প্রোফেশনাল কন্ট্যাক্ট সাইন করলাম আমার জন্মদিনে, ১৩ ই মে। সাইন করে টরে ফিফা আর টেলিভিশনের ক্যাবল প্যাকেজ কিনে সোজা বাড়ি। ততদিনে ফুটবল সীজন শেষ। বাড়িতে বসে খুব চিল করছি। সে বছর বেলজিয়ান লীগের অবস্থা খুব উড়াধুড়া ধরণের। আন্দেরলেখট আর স্ট্যান্ডার্ড লিগ সিজন শেষ করেছে সমান পয়েন্ট নিয়ে। দুই লীগের প্লে অফ হবে কে চ্যাম্পিয়ন তা ঠিক করার জন্যে।

প্রথম লেগে আমি স্রেফ ফ্যান। টিভিতে খেলা দেখলাম। সেকেন্ড লেগের আগের দিন কোচের ফোন।

“হ্যালো?”
“হ্যালো,রোম। কি করিস?”
“পার্কে ফুটবল খেলতে বের হচ্ছিলাম।“
“না, না, না, না। এক্ষুনি ব্যাগ গোছা। এক্ষুনি।
“কি? আমি আবার কি করলাম?”
“না, না, না। তোকে এক্ষুনি স্টেডিয়ামে আসতে হবে। ফার্স্ট টীম তোকে চাচ্ছে।“
“ইয়ো…হোয়াট?! আমি?!”
“হ্যাঁ, তুই। এক্ষুনি চলে আয়।“

ফোন রেখে আক্ষরিক অর্থেই দৌড়ে বাবার রুমে ঢুকে গেলাম। ইয়ো! উঠে পরো বাপজান। আমাদের যেতে হবে।

বাবা বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ”হাহ? কি? কোথায় যেতে হবে?”

“আন্দেরলেখট, ম্যান!”

ঐ সময়টা আমি কখনোই ভুলবো না। স্টেডিয়ামে ঢুকে আমি মোটামুটি দৌড়েই ড্রেসিংরুমে ঢুকে গেলাম। কিটম্যান জিজ্ঞাসা করলো, “তো, কিডো, কোন নাম্বারটা চাস?”

বললাম, “১০ নাম্বার দিন।“

হা হা হা হা হা! আমি আসলে জানিনা। ওই বয়সে আসলে কি ভয় পাওয়া উচিৎ তা জানতাম না।

আমাকে কিটম্যান বললেন, “অ্যাকাডেমী প্লেয়ারদের ৩০ এর উপর নাম্বার নিতে হয়।“

“ওকে। তিন যোগ ছয়, নয় হয়। কুল…ম্যান। আমাকে ৩৬ নাম্বার দিন।“

ঐ রাতে ডিনারে সিনিয়র প্লেয়ারেরা আমাকে দিয়ে গান গাওয়ালো। ঠিক মনে নেই কোন গানটা গেয়েছিলাম। আমি তো তখন ঘোরের মধ্যে।

পরেরদিন আমার এক বন্ধু বাড়িতে এসে আমার খোঁজ করেছিলো। পার্কে খেলতে যাবো কিনা জানতে এসেছে। মা বলে দিলো, “ও তো খেলতে চলে গেছে।”

বন্ধু জিজ্ঞাসা করলো, “খেলতে? কোথায়?”
“আর কোথায়? ফাইনাল খেলতে গেছে।”

বাসে করে আমরা স্টেডিয়ামে গেলাম। প্রতিটা খেলোয়াড়ের গায়ে ক্যুল স্যুট। ধীরস্থির হেঁটে ঢুকছে সবাই। আমার গায়ে এক উৎকট ট্র্যাকশ্যুট চাপানো। টিভি ক্যামেরা সব যেন আমারই মুখের উপরে ধরা। বাস থেকে লকার রুম ৩০০ মিটার। কত হবে আর, মিনিট তিনেকের হাঁটা পথ। লকার রুমে পা রাখা মাত্র আমার মোবাইল মনে হলো পাগল হয়ে গেলো। তিন মিনিটে আমার মোবাইলে ২৫ টা মেসেজ এসেছে। টিভিতে দেখে আমার বন্ধুরা পুরো পাগলা হয়ে গেছে।

“ব্রো?! তুই এই খেলায় কেন?”
“রোম, কি হচ্ছে এইসব” তোকে টিভিতে দেখাচ্ছে কেন?”

শুধু একজনের মেসেজ ব্যাক করেছিলাম। আমার প্রাণের বন্ধু। লিখেছিলাম, “দোস্ত আমি খেলবো কিনা জানিনা। কি হচ্ছে তাও জানিনা। টিভিতে দেখতে থাক শুধু।“

৬৩ মিনিটের সময় ম্যানেজার আমার কাঁধে চাপড় দিলেন। আন্দেরলেখটের হয়ে মাঠে নেমে গেলাম। আমার বয়স তখন ১৬ বছর ১১ দিন।

সেদিনের সেই ফাইনালে আমরা হেরেছিলাম। তাতে কি! আমি ছিলাম সুখের সাত সমুদ্রে। মায়ের কাছে দেয়া, আমার দাদুর কাছে দেয়া কথা আমি রাখতে পেরেছি। মাঠে নামার মুহুর্তটাতেই আমি জেনেছি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। একেবারে সব।

পরের সীজনে, আমি তখনো হাই স্কুলে পড়ছি আবার একই সাথে ইওরোপা লীগে খেলছি। স্কুলে আমি সাধারণত একটা বড় ব্যাগ নিতাম যাতে স্কুল শেষে বিকেলে ফ্লাইট ধরতে পারি। বিশাল ব্যবধানে আমরা লীগ জিতলাম। আফ্রিকান প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ারে আমি দ্বিতীয়। কি বলবো…অস্থির…পুরো অস্থির।

এসব কিছুরই আশা আমার ছিলো। জানতাম এরকমই হবে। কিন্তু এত দ্রুত হবে তা জানতাম না। হঠাত করেই মিডিয়া আমার উপর আশা করা বাড়িয়ে দিলো। যেন সমস্ত আশা ভরসা মূল আমি। বিশেষ করে জাতীয় দলে। ঠিক কি কারনে জানি না, বেলজিয়ামের হয়ে আমি ঠিক ভালো খেলতে পারছিলাম না। হচ্ছিলো না ঠিকঠাক সব।

বাট, ইয়ো-কাম অন। আমার বয়স তখন কত? ১৭! ১৮! না হয় ১৯!

যখন সব ঠিকঠাক হলো তখন খবরের কাগজে বিভিন্ন আর্টিকেলে দেখলাম লিখছে, রোমেলু লুকাকু, দ্য বেলজিয়ান স্ট্রাইকার। যখন সব ঠিক থাকে না তখন লিখছে, রোমেলু লুকাকু, কঙ্গোলিজ বংশোদ্ভুত বেলজিয়ান স্ট্রাইকার। যেভাবে আমি খেলি, সেটা আপনার পছন্দ নাই হতে পারে। অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু আমি এখানে জন্মেছি। বড় হয়েছি অ্যান্টওয়ের্প, লীগ, ব্রাসেলসে। স্বপ্ন দেখেছি আন্দেরলেখটের হয়ে খেলার। ভিনসেন্ট কোম্পানি হবার স্বপ্ন দেখেছি। আমার মুখের কথা শুরু হয় ফ্রেঞ্চ দিয়ে শেষটা হয় ডাচ। এর মাঝে আমার এলাকা বুঝে কথার মধ্যে স্প্যানিশ বা পর্তুগীজ বা নিদেনপক্ষে লিঙ্গালাও ঢুকে যায়।

কারণ আমি বেলজিয়ান। আমরা সবাই বেলজিয়ান। এজন্যেই এই দেশটা দুর্দান্ত, তাই না?

আমার দেশেরই কিছু লোক চায় আমি যাতে ব্যর্থ হই, কেন চায় তা আমি ঠিক জানি না। আসলেই জানিনা। যখন আমি চেলসিতে গেলাম, আমি খেলিনি। সবার হাসি শুনেছি তখন। যখন আবার ধারে ওয়েষ্টব্রমে গেলাম খেলতে তখনও আমি ওদের হাসিটা শুনেছি।

সমস্যা নেই। এসব লোকের পরোয়া করিনা। আমার সিরিয়ালে যখন দুধের বদলে জল মেশানো হয়েছে তখন এরা কেউ ছিলোনা। আমার যখন কিছুই ছিলো না তখন যেহেতু এরা আমার পাশে ছিলোনা তাই এদের পক্ষে আমাকে বোঝা সম্ভব না।

মজার কথা কি জানেন? সেই বাচ্চা অবস্থাতে আমি টানা দশটা বছর চ্যাম্পিয়নস লীগ ফুটবল মিস করেছি। আমাদের টিভি দেখার সামর্থ্যই ছিলোনা। সব বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে ফাইনাল নিয়ে কথা বলতো, আমিতো কিছুই জানি না। জানবো কিভাবে, দেখিনি তো! আমার ২০০২ এর কথা মনে আছে। সেবার মাদ্রিদ লিভারকুসেনের সাথে খেলেছিলো। সবাই খেলা শেষে এসে বলছিলো, “ভলিটা! ওহ মাই গড, কি ভলি!”

সবার সাথে সাথে আমিও চোখ কপালে তুলেছি। আসলেই! কি অসাধারন ভলি! এমন ভাব যেনো আমি ভলিটা নিজে চোখে দেখেছি। খুব সুন্দর অভিনয়। দরিদ্রদের মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে হলে খুব ভালো অভিনয় জানতে হয়। এর দু সপ্তাহ পর কম্পিউটার ক্লাসে আমার এক ক্লাসমেইট নেট থেকে ভিডিওটা ডাউনলোড করেছিলো। তখন দেখলাম জিদানের সেই অবিশ্বাস্য ভলি!

ঐ গ্রীষ্মে আমি সেই ক্লাসমেইটের বাড়িতে গিয়েই বিশ্বকাপ ফাইনালে রোনালদো- দ্য ফেনোমেনন এর কীর্তি দেখলাম। তাও নেট থেকে নামানো ফাইল। কতো শুনেছি এই গোলগুলোর গল্প। ঘন্টার পর ঘন্টা সবাই গোলগুলো নিয়ে গল্প করেছে। সেইসব গোল! আমিও সবার কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে গেছি।

ওইসময়টায় আমার জুতোয় ছিদ্র ছিলো। বেশ বড় বড়। ঠিক ১২ বছর পর আমি খেললাম বিশ্বকাপে। এবারেও খেলবো আরেকটা বিশ্বকাপ। তবে বিষয় কি জানেন, এবারে আমার মাথায় মজা করার ভুত চেপেছে। এত চাপ, নাটকের ভীড়ে আসলে জীবনটা খুবই ছোট। আমাদের দল বা আমাকে নিয়ে যে যা ইচ্ছা বলুক, কিসসু যায় আসে না। এবার মজাই করবো।

ভাই, শোনেন-যখন ছোট ছিলাম, থিয়েরে অঁরির ম্যাচ টিভিতে দেখার পর্যন্ত সামর্থ্য ছিলোনা ! আর এখন! প্রতিটা দিন ওর সাথে আমাদের জাতীয় দলে থাকছি। শিখছি ওর কাছ থেকে। জীবন্ত এক কিংবদন্তীর পাশে রক্তমাংসের এই আমি দাঁড়িয়ে শুনি কিভাবে দুই খেলোয়াড়ের মাঝের ছোট্ট ফাঁকা জায়গাটায় চিতার ক্ষিপ্রতা নিয়ে দৌড়াতে হয়। যেমনটা অঁরি নিজে করতো। এই দুনিয়ায় অঁরিই সম্ভবত একমাত্র মানুষ যে আমার চাইতে বেশি খেলা দেখেছে টিভিতে। আমরা সবকিছুতেই তর্ক করি। এমনকি পাশে বসে জার্মানীর দ্বিতীয় বিভাগের ফুটবল নিয়েও কথা বলি। পাগলামো বলতে পারেন অবশ্য।

এই যেমন বলি, “থিয়েরি, ফরচুনা ড্যুসেলডর্ফের সেট আপটা দেখেছেন?”

“ডোন্ট বি সিলি রোম। অবশ্যই দেখেছি।”

এই যে দৃশ্যটা, কথাগুলো, এগুলোই আমার জন্যে “কুলেষ্ট থিং”। প্রায়ই মনে হয়, আহারে, আমার দাদুটা যদি দেখে যেতে পারতো! আমি প্রিমিয়ার লীগ নিয়ে বলতাম না। ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড নিয়ে কথা বলতাম না। চ্যাম্পিয়নস লীগ নিয়ে না। বিশ্বকাপ নিয়েও না। কিছু নিয়েই আলাদা করে দাদুকে কিছু বলার নেই আমার। শুধু যদি আমাদের জীবনটা দেখে যেতে পারতো! আরেকটা বার যদি দাদুর সাথে ফোনে কথা বলতে পারতাম, যদি জানাতে পারতাম।

দেখেছো দাদু? বলেছিলাম না? তোমার মেয়েটা ঠিক আছে এখন। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে এখন কোন ইঁদুর নেই। আমাদের আর মেঝেতে ঘুমোতে হয়না। আমাদের এখন কোন কষ্ট নেই। আমরা ভালো আছি। ভালো আছি..

ওদের আর আমার আইডি চেক করতে হয়না। ওরা এখন আমার নামটা জানে। রোমেলু লুকাকু…


মূল: দ্য প্লেয়ার্স গার্ডিয়ান।
অনুবাদ: মানিক চন্দ্র দাস।

মতামত দিনঃ