লেখার টাইটেল দেখে চমকাবার কিছু নাই। বিজ্ঞানের আসলেই কোন মা-বাপ নাই। কেন নাই, সেটা এই লেখায় কিছুটা হলেও বলার চেষ্টা করব। এই মা-বাপ কিন্তু বায়োলজিকাল মা-বাপ না। সেটা চিন্তা করলেই আপনি ধরা।
বিজ্ঞান মানে যাচাই-বাছাইয়ের বিশেষ জ্ঞান। উইকিপিডিয়ায় এর একটা ভালো সংজ্ঞা আছে, ল্যাটিন শব্দ সায়েনটিয়া (scientia) থেকে ইংরেজি সায়েন্স শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ বিশেষ জ্ঞান।
আমাদের আশেপাশের যা কিছু পর্যবেক্ষন যোগ্য তা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পর্যবেক্ষন করা, এবং আহরিত জ্ঞান লিপিবদ্ধ করাটাই বিজ্ঞানের কাজ। বিজ্ঞান সব সময় তিনটা প্রশ্নের জবাব খোঁজে, কি ?, কেন ?, কিভাবে ? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই তিনটা প্রশ্ন নানা ভাবে করা হলেও মূল জিজ্ঞসা এইগুলোই।
বিজ্ঞানের এই গবেষনায় প্রতিনিয়ত বের হয়ে আসছে নতুন নতুন তথ্য, উপাত্ত আর পদ্ধতি। সেগুলো কাজে লাগিয়েই আমরা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাই। আবিষ্কার হয়েছে বিদ্যুৎ, সেচ যন্ত্র, ফসল ফলানোর আধুনিক পদ্ধতি, ইমারত তৈরির কৌশল, চিকিৎসার উপকরন এবং ঔষধ।
ছোটবেলায় স্কুলে থাকতে একটা রচনা খুব বিখ্যাত ছিল, “বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ” এই শিরোনামে। সেখানে নানা ভাবে বিজ্ঞানের অবদান স্বীকার করে বলা হয়েছিল; বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।
কথাটা কিছুটা হলেও মিথ্যে নয়। বিজ্ঞান নানা ভাবে জীবনকে গতিশীল করার সাথে সাথে আমাদের আবেগের ঘাটতিও তৈরি করেছে। চিঠি লেখার যে আবেগ, তার উত্তর পাবার যে প্রতীক্ষা সেটা কেড়ে নিয়েছে প্রযুক্তি। নিমিষেই এখন ভিডিও কল আর ইমেইলে যোগাযোগ করা যাচ্ছে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে। ইনস্ট্যান্ট ম্যসেজিং এর জয়জয়কার সবদিকে।
বিজ্ঞান আসলে এখন কারো আবেগের ধার ধারে না। কি হবে বা কি হতে পারে সেটা চিন্তা করার সময় বিজ্ঞানের নেই। আপন নিয়মে সে শক্তি সঞ্চয় করে প্রযুক্তির উতকর্ষ সাধন করেই যাবে। শিল্প-বিপ্লবে কতজন শ্রমিক চাকুরী হারাবে সেটা বিজ্ঞান তাই ভাবে না।
নতুন নতুন মেশিন যতই আসবে, ততই কম প্রয়োজন হবে মানুষের। কারন বেশিরভাগ কাজই এখন যন্ত্র করে দেয়।
আবার মানুষ নিয়ে একদম যে ভাবে না বিজ্ঞান সেটা বললেও ভুল হবে। বিজ্ঞানের যে অংশ মানুষ নিয়ে কাজকর্ম করে তার নাম সমাজবিজ্ঞান। যদিও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে সমাজবিজ্ঞান আর প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এক অপরের সাথে কতটুকু সামঞ্জস্য রেখে চলে সে বিষয়ে।
যে কথা বলে শুরু করেছিলাম এই লেখা সেখানে ফিরে যাওয়া যাক, বিজ্ঞানের কোন মা-বাপ নেই!
বিজ্ঞান জীবন রক্ষাকারী ঔষুধের বা টিকার গবেষনা যেমন করে, তেমনে জীবননাশী অস্ত্রেরও গবেষনা করে। কার মারণাস্ত্র কত নিখুত ভাবে কত বেশি খুন করতে পারে সেটাও বিজ্ঞানীরা গবেষনা করেন।
কারন বিজ্ঞানের কোন মা-বাপ নেই। এটা অনেকটা পানির মত। পরিমান নিয়ন্ত্রন করতে পারলে ভালো, নয়ত তা বন্যা হয়ে আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তো যার মা-বাপ নেই তাকে শাসন করারও কেউ নেই। এইখানেই মানুষ হিসেবে আমাদের ব্যার্থতা।
বিজ্ঞান হচ্ছে তথ্য বা জ্ঞান সংগ্রহ করে তা কাজে লাগানোর পদ্ধতি। এই বিশেষ ভাবে লব্ধ জ্ঞান আপনি কি কাজে লাগাবেন সেটা নির্ভর করে আপনার নৈতিকতার উপর। কোন দেশ যখন পরমানু অস্ত্র বানায় তখন তার দেশের বিজ্ঞানীরাই সেখানে কাজ করেন। এখানে যতটা না বৈজ্ঞানিক আর বিজ্ঞানের দোষ, তার থেকে বেশি দোষ ঐ দেশের নীতি নির্ধারকদের।
এই একই পরমানু গবেষনা থেকে বের হয়ে এসেছে সৃষ্টি রহস্যের অনেক গোপন তথ্য, আমরা পেয়েছি জ্বালানী হিসেবে অফুরন্ত শক্তির উৎস।
মোদ্দা কথা হল, মা-বাপ ছাড়া এই বিজ্ঞানকে কোন কাজে লাগানো হবে সেটা একান্তই নির্ভর করবে ব্যাক্তি বা সমাজ হিসেবে একটা দেশ আর তার মানুষেরা কতটা নৈতিক তার উপর।
বিজ্ঞানের বাপ-মা হবে কারা?
জীবানু নিয়ে গবেষনা করা একজন বৈজ্ঞানিকের নৈতিকতা থাকলে তিনি ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের চেষ্টায় থাকবেন। নয়ত তিনি জীবানু অস্ত্র আবিষ্কার করবেন। তার গবেষনার উদ্দেশ্য নিয়ন্ত্রন করবে তার নৈতিকতা। তাই বিজ্ঞানের প্রথম বাপ-মা হল ব্যাক্তির নৈতিকতা।
দ্বিতীয়ত, একটা দেশের সরকার নির্ধারন করে (আদতে তারাও মানুষ) তার দেশের গবেষনা খাত কোনদিকে যাবে। কৃষিতে এগিয়ে থাকা দেশ অবশ্যই কৃষিবিজ্ঞানে নজর দেয় আর যুদ্ধবাজ দেশ নজর দেয় অস্ত্র উৎপাদনে।
বিজ্ঞানের কি দোষ?
বিজ্ঞানকে শাসন করার আরেকটা জায়গা হল, ধর্ম। শুনতে কটু লাগলেও কথা সত্য। সেই আদি আমল থেকেই মানুষ তার বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেয় যুক্তির উপরে। তাইতো, আমেরিকায় প্রতিনিয়ত দেখবেন গর্ভপাত (Abortion) এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। এখানে তাদের চার্চ একটা বড় ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞান কি করতে পারবে আর পারবে না সেটা নির্ধারনের অনেক চেষ্টা অতীতে করেছে চার্চগুলো এখন শক্তিতে আর বুদ্ধিমত্তায় কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে।
এই বিশ্বাসের বলে তারা পুড়িয়ে মেরেছিল Filippo Bruno এর মত বিজ্ঞানীকে। তারপরেও কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কারন ব্যাক্তির ধ্বংস আছে, সত্য কিংবা মতবাদের নয়।
ঠিক এই জায়গাটাতেই বিজ্ঞানের কোন মা-বাপ নেই।
যা কিছু অসত্য, অযৌক্তিক আর অপ্রয়োজনীয়, বিজ্ঞান তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ করার সাথে সাথে নিজেকেও শুধরে নেয়। আজ কোন একটা এন্টিবায়োটিক ভালো প্রমানিত হলেই চিকিৎসা বিজ্ঞান সেটা নিয়ে বসে থাকবে না। সেই বিশ্বাস বিজ্ঞানের নেই। এর থেকে আরো ভালো কিছু বের হবার পর চিকিতসকরা নতুন ঔষধ নিয়েই কাজ করবেন।
নিজেকে নিজে প্রতিনিয়ত উন্নত করার আর শুধরে নেবার এই যৌক্তিক চেষ্টাই বিজ্ঞানের মা-বাপ হতে পারে।
আপনার প্রিয়জন মরনাপন্ন হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে আপনি ডাক্তার দেখাবেন নাকি দেখাবেন না, সেট আপনার ব্যাক্তিগত বিষয়। কিন্তু যদি দেখান তবে যুক্তি বলে আপনার রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
আজ যদি আপনি নারী শিক্ষার বিরোধিতা করেন তবে এক সময় আপনার স্ত্রী বা কন্যার প্রসবকালীন জটিলতায় নারী ডাক্তার খুঁজে পাবেন না। আপনার যুক্তি কি বলে?
পরিবর্তনকে যে সমাজ আর রাষ্ট্র স্বাগত জানায় তারাই বিজ্ঞানকে শাসন করতে পারে, তারাই বিশ্বকে শাসন করবে। আর যদি তা না করে তবে সেই রাষ্ট্র সবসময় পরনির্ভরশীল হয়ে থাকবে।
আধুনিক বিশ্বে, যে কোন দেশের সভ্যতার মাপকাঠি হবে সে দেশের জনগন কতটা বিজ্ঞান মনষ্ক তার উপর।
টুকরো টুকরো কথা, বিষদ না হলেও মোটা মুটি আলোচনা করা যেত বিষয়টা নিয়ে, যাই হোক উদ্দেশ্য মহৎ…..
একটা ভুমিকার অবতরন করা হল মাত্র। বিজ্ঞান অনেকটা রান্না করার ছুরির মত। সঠিক হাতে ভোজন আর ভুল হাতে মরন।
কোন বিষয়ে বিস্তারিত বলব সেটা যদি বলতেন তবে উপকার হত।