হোমিওপ্যাথির ইতিবৃত্ত –


হোমিওপ্যাথি নিয়ে অনেকদিন ধরে লিখব লিখব করেও সময় পার করছিলাম। কারন হোমিওপ্যাথি নিয়ে কিছু বলতে গেলে আমি দেখেছি অধিকাংশ বাঙ্গালীরই কোথাও একটা ঘা লাগে।

কেন?

কারন সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই তুকতাক আর ইউনানীতে বাঙ্গালীর অগাধ আস্থা। হোমিওপ্যাথি আসলে কি বা শরীরে কিভাবে কাজ করে তা না জেনেই তাই প্লাসিবো ইফেক্টে ভোগে বাঙালী। ডাক্তারদের কসাই ভাবা আর হাসপাতাল ব্যবসায়ী… সব মিলে হোমিওপ্যাথিকে করেছে গরীবের জন্য বাঁচার একটা সম্বল।

কিন্তু আদতেই কি হোমিওপ্যাথি কাজ করে? চিকিৎসা বিজ্ঞানের বাকি শাখা গুলোর সাথে এর পার্থক্য কোথায়? এই সব নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যই এই লেখার শুরু।

হোমিওপ্যাথি জিনিসটা কি? / কিভাবে এর শুরু?

হোমিওপ্যাথিকে বিকল্প ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থা বলা হয়। প্রাকৃতিক কিছু উপদানকে নির্দিষ্ট দ্রবনে গুলিয়ে বিভিন্ন রোগের ঔষুধ বানানোই হোমিওপ্যাথির মূল কাজ ছিল। বর্তমানে সারা বিশ্বজুড়ে হোমিওপ্যাথিকে একটা ফ্রড বিজনেস ধরা হয় এবং কোন ধরনের ইন্সুরেন্স দেয়া হয় না হোমিওপ্যাথি গ্রহন করা রোগীদের।

এটার কিছু কারনের একটা হল, এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞান বা কোন হোমিওপ্যাথ গবেষনা করে দেখাতে পারেনি কিভাবে এই বস্তু কাজ করে বা আদতেও কোন কাজ করে কিনা। যদিও দিস্তার পর দিস্তা কাগুজে লেখেলেখি তারা করেছেন এই শাস্ত্র নিয়ে। যেখানে দাবি করা হয়েছে কত রোগের মহাঔষধ এই হোমিওপ্যাথি।

কিন্তু, বললেই তো আর হয়ে যায় না। আপনাকে তার স্বপক্ষে প্রমান দিতে হয়। যেটা এখন পর্যন্ত পারেনি হোমিওপ্যাথি।

১৮’শ শতকের শেষের দিকে সামুয়েল হানিম্যান (Samuel Hahnemann) এর হাত ধরে জার্মানিতে হোমিওপ্যাথির সূচনা হয়। তিনি তখন জার্মানিতে বেশ নামকরা একজন ডাক্তার।

তার মটো ছিল “like cures like” মানে অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত। তার মতে কোন একটা টক্সিনের খুব অল্প পরিমান দ্রবনে ব্যবহার করে সেই দ্রবন দিয়ে, টক্সিন বেশিমাত্রায় শরীরে গেলে যে উপসর্গগুলো দেখা যাবে তার চিকিৎসা করা সম্ভব। যেমন শরীরে র‍্যাশ উঠলে পয়জন আইভি ব্যবহার করে তার চিকিৎসা করা যায়।

এই ধারনা কিন্তু নতুন নয়। পদ্ধতিগত ভিন্নতা থাকলেও আমরা কিন্তু ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে এইরকম আইডিয়াই ব্যবহার করে থাকি। যেখানে কোন একটা ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাসের নির্দিষ্ট কিছু মলিকিউল / স্ট্রেইন/ অংশ নিয়ে মানব শরীরের প্রবেশ করানো হয় এবং শরীরের নিজস্ব ইমিউন সিস্টেমকে জাগিয়ে তোলা হয়। ফলে পরবর্তিতে ঐ প্যাথোজেন যখন শরীরে প্রবেশ করলে আমাদের শরীর বুঝতে পারে কি ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে।

এটা খুবই নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় করতে হয়, অসংখ্যবার ল্যাবটেস্ট আর ট্রায়ালের পর। ব্যকটেরিয়া বা ভাইরাসের যে অংশ আমাদেরকে টিকার মাধ্যমে দেয়া হয় (এন্টিজেন) তা আসলে মানবদেহে কোন ক্ষতি করতে সক্ষম নয়। এরা হয় মৃত বা জেনেটিকালি নিষ্ক্রিয়। সুবিধা হচ্ছে এর ফলে শরীর এন্টিবডি তৈরি করে ফেলে এবং এই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া আমাদের আর কোন ক্ষতি করতে পারে না।

যদিও, হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রে ডাক্তার এবং কেমিষ্টরা খুব দ্রুতই বুঝতে পারেন যে মাত্রায় হোমিওপ্যাথিক ঔষুধে টক্সিন দ্রবিভুত করা হয় তাতে আদতে কোন টক্সিনই আর থাকে না বা এটাকে ঔষুধ হিসেবে গন্য করাই যায় না।

পরিতাপের বিষয় হল, যেহেতু এটাতে কোন টক্সিনই আর উল্লেখযোগ্য পরিমানে থাকে না, তাই এটা খেলে মানবদেহে কোন ক্ষতিকারক প্রভাবও পড়ে না। মানে আপনি অসুস্থও হবেন না, আবার ভালোও হবেন না।

তাহলে হোমিওপ্যাথি খেয়ে অনেকে লোক যে বলে তারা সুস্থ হয়েছে বা উপকার পাচ্ছেন?

এটার একটা গালভরা নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এটাকে তারা প্লাসিবো ইফেক্ট (placebo effect) বলেন। প্লাসিবো ইফেক্টের কারনে রোগিরা মনে করেন তারা আসলেই কোন বিশেষ ঔষুধ খাচ্ছেন তাতে কাজ হবে। মানুষের ব্রেইন এই বিশ্বাসকে ধরে নিয়েই শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা চালু করে দেয়। তার সুস্থ হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

প্লাসিবো ইফেক্ট নিয়ে বেশ মজার মজার কিছু এক্সপেরিমেন্ট করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। একটু গুগল করলেই তা পেয়ে যাবেন। যেখানে একজন সুস্থ ব্যক্তিকে “আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে” বারবার বলার পরে সে আসলেও অসুস্থ বোধ করে। আফ্রিকার ভুডু যাদুকরেরা এই প্লাসিবো ইফেক্টের ব্যাপক ব্যাবহার করে।

যেভাবে বানানো হয় হোমিওপ্যাথিক ঔষুধ

হোমিওপ্যাথিক ঔষুধ বানানো হয় কোন একটা দ্রবনকে আরো দ্রবীভুত করে। অনেকটা সিরিয়াল ডাইলুশন এর মত। এটাকে সাকসেশন বলে। প্রতিটা হোমিওপ্যাথিক ঔষুধের বোতলের গায়ে এই দ্রবনের মাত্রা লেখা থাকে। সাধারনত হোমিওপ্যাথিক দ্রবন 30X মাত্রার হয়। এখানে X এর মান ধরা হয় 10, কোন বোতলের গায়ে যদি 30X লেখা থাকে তাহলে কি বুঝব?

এর মানে হল, কোন একটা টক্সিন বা সাবস্টেন্স (ধরে নিলাম পয়জন আইভি) এর একটা পার্ট ১০ ভাগ পানি বা এলকোহলের সাথে মেশানো হয়। এটা ভালভাবে নেড়ে দ্রবিভুত করা হয়। এর পর এই দ্রবনের একভাগ নিয়ে আবার ১০ ভাগ পানিতে বা এলকোহলে মেশানো হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া ৩০ বার করা হয়। তাহলে আপনি পেয়ে গেলেন 30X মাত্রার হোমিওপ্যাথিক ঔষুধ।

যদি কোন ঔষুধও দেয়া হয়ে থাকে এই দ্রবনে, এতবার দ্রবন বানানোর পরে তার একটা মোল পেতে আপনার ৮০০০ গ্যালনের মত পানি খেতে হবে। এর অনুপাত থাকে (1:1030) ।

এই এতবার দ্রবন থেকে আবার দ্রবন বানানোর কারনেই কেমিষ্টরা বলেছেন, হোমিওপ্যাথিতে আসলে কোন ঔষুধই আর অবশিষ্ট থাকে না।

আবার কিছু হোমিওপ্যাথিক বোতলের গায়ে লেখা থাকে 30C । এর মানে ১০০ এর উপরে ৩০ টা শুন্যের পাওয়ার (10030) । বাস্তবে এই মাত্রার দ্রবন বানানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কারন পুরো সৌরজগতেও এত পানি নেই ঃ)।

আসলে সমস্যাটা হয়েছিল, হানিম্যান যখন তার এই দ্রবনের থিওরি দেন তখন কেমিষ্ট্রিতে মোল এবং এভোগেড্রো নাম্বার (Avogadro constant / 6.02214086 × 1023 mol-1), এর ধারনা ছিল না।

স্কুলে অষ্টম নবম শ্রেনীতে বিজ্ঞান বইয়ে এভোগেড্রো নাম্বারের সংজ্ঞা দেয়া আছে। এই নাম্বার একটা কন্সটেন্ট। এটা বলে দেয় পদার্থের এক মোলে কি পরিমান অনু বা মলিকিউল আছে।

The number 6.022 × 1023 indicating the number of atoms or molecules in a mole of any substance

বিক্রিয়া বা দ্রবনের উপর ভিত্তি করে এই সংখ্যা ইলেক্ট্রন, অনু, আয়ন বা মলিকিউল যে কোন কিছুকেই বোঝাতে পারে। কিন্তু কোন ভাবেই এই কন্সটেন্ট এর বাইরে যাবে না।

তাই হানিম্যান এবং তার শিষ্যরা দ্রবন বানানোর পদ্ধতি ঠিকই করে যাচ্ছিল কিন্তু তারা দ্রবন থেকে যে মূল উপদানই সরিয়ে নিচ্ছিল সেটা জানত না। আফসোস।

হোমিওপ্যাথির ইতিবৃত্ত - 1

হোমিওপ্যাথি কি আদতেও কাজ করে?

এই ব্যপারে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই। তুলনামূলক ভালো রিসার্চের সংখ্যাও নগন্য। তবে বর্তমানে যারা হোমিওপ্যাথির প্র্যাকটিস করেন তারা মোল এবং এভেগেড্রো নাম্বারের মাহাত্ব্য জানেন।

তারা তাই হোমিওপ্যাথির ঔষুধের রোগ ভালো করার ক্ষমতাকে “Water Memory” তত্ত্বের আওতায় ফেলতে চান। এই ওয়াটার মেমরি বা পানির স্মৃতি ধারনা অনেকটা এরকম, পানির দ্রবন তার মধ্যে থাকা ঔষধের আকৃতি এবং গুনাগুন মনে রাখতে পারে, তাই দ্রবনে যত অল্প অনুই থাকুক না কেন সেটা কাজ করবে।

আপাতত পদার্থবিজ্ঞান দিয়ে চিন্তা করলে ব্যপারটা খুবই হাস্যকর আর অবৈজ্ঞানিক। পানির নিজস্ব কোন স্মৃতি থাকার কথা না। সাধারন তাপমাত্রায় পানি এক পিকোসেকেন্ডের বেশি তার আকৃতি ধরে রাখতে পারে না, সেখানে সে স্মৃতি জমাবে কোথায়?

আর পানি যদি স্মৃতি ধরেই রাখতে পারত তবে পৃথিবীর সব পানিই আসলে ঔষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যেত।

ঘুরে ফিরে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ঐ এক দিকেই যায়, সেটা হল কার্যত হোমিওপ্যাথি কোন কাজের না। যা কাজ হয় সেটা ওই প্লাসিবো এফেক্টের কারনেই হয়ে থাকে। মনের শান্তি বড় শান্তি।

একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, হোমিওপ্যাথি সেই সকল রোগেরই পথ্য হিসেবে কাজ করে যেগুলো আমাদের শরীর নিজে থেকে প্রতিরোধ করতে পারে। যেমন, জ্বর, স্বর্দি, গ্যাস্ট্রিক ইত্যাদি।

কিন্তু যদি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে যেমন হার্টের সমস্যা, ক্যান্স্যার, বা জলবসন্তের মত ভাইরাসের বিরুদ্ধে হোমিওপ্যাথি কোন কাজ করে না। এলকোহল বেইসড হোমিওপ্যাথিতে ঠান্ডা কাশির উপশম হওয়াটা আসলে এলকোহলেরই গুন।

হোমিওপ্যাথির বিপদ

হোমিওপ্যাথির ঔষধ থেকে বিপর্যয়ের ঘটনা খুব কম ঘটলেও মূল বিপদটা অন্য জায়গায়। হোমিওপ্যাথি সেবন করা রোগীরা কার্যত অন্য কোন চিকিৎসা নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। ফলে তাদের মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়।

Pseudoscience বলে একটা কথা আছে ইংরেজীতে, এটাকে মিথ্যা বিজ্ঞান বলে। মানে দেখতে শুনতে যুক্তিপূর্ন আর বিজ্ঞানের আবহ থাকলেও আসলে কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। উইকিপিডিয়ায় এভাবেই হোমিওপ্যাথিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

হানিম্যানের পরে আদতে হোমিওপ্যাথির মৃত্যু হয়েছে। সেই মৃত শব নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন এখনকার প্র্যাকটিস করা ব্যক্তিরা। পৃথবীজুড়ে তাই তুকতাকে বিশ্বাসী মানুষের কাছেই এর কদর। যদিও দিনদিন এর ব্যবহার কমে আসছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে।

হোমিওপ্যাথির ঔষধের মূল উপাদান

প্রাথমিক ভাবে বিভিন্ন ক্যমিকেল এবং প্রাকৃতিক উপদান দ্রবনে ব্যবহার করা হলেও যে উপদানগুলো সব থেকে বেশি ব্যবহার করা হত তার মধ্যে পয়জন আইভি, সাদা আর্সেনিক, মৌমাছির গুড়া এবং আর্নিকা নামের একোটা হার্ব উল্লেখযোগ্য।

হানিম্যানের সময়কালে তিনি দ্রবনের Extreme Dilution এর উপর বেশি গুরুত্ব দিতেন। তার বিশ্বাস ছিল এর ফলে কেমিকেলের খারাপ দিক গুলো চলে যাবে আর শুধু মাত্র ঔষধি গুন বজায় থাকবে।

হোমিওপ্যাথির ইতিবৃত্ত - 2

হোমিওপ্যাথির জনপ্রিয়তা এবং পতন

হানিম্যানের পর তার ছাত্র Hans Birch Gram ১৮২৫ সালে আমেরিকায় প্রথম হোমিওপ্যাথির প্রবর্তন করেন আর ১৮৩৫ সালে প্রথম স্কুল চালু করেন। এর পরে পর্যায়ক্রমে ১৮৪৪ সালে আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব হোমিওপ্যাথির যাত্রা শুরু হয়।

মূলত উনিশ শতকের শুরুতে ছিল হোমিওপ্যাথির জয়জয়কার। কারন বর্তমান এলোপ্যাথির বা আধুনিক মেডিসিনের তখনো সুচনা হয়নি। তখনকার ডাক্তাররা যে সকল ট্রিটমেন্ট আর সার্জারী করতেন তা ছিল অনেকটা অবাস্তব আর বেশিরভাগ সময়েই প্রানসংহারী। অপরদিকে হোমিওপ্যাথিতে আর কিছু না হলেও রোগী মরে যেত না। তাই সবাই এই চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকেছিল।

আঠার শতকের শেষ আর উনিশ শতকের শুরুর একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল হোমিওপ্যাথির অগ্রযাত্রা। কারন কলেরার মত মহামারীতে যখন অন্যান্য হাসপাতালে রোগি মৃত্যুর হার অনেক বেশী ছিল সেখানে হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল গুলোতে ছিল তুলনামূলক ভাবে কম।

হোমিওপ্যাথির এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও উনিশ শতকের অনেক বিজ্ঞানী এবং মূলধারার চিকিৎসকরা একে অকার্যকর বলে গেছেন। আমেরিকান ফিজিশিয়ান এবং লেখক অলিভার ওয়েন্ডেল হোম এর কড়া সমালোচক ছিলেন এবং বেশ বড়সড় একটা প্রবন্ধ (Homeopathy and Its Kindred Delusions) রচনা করেছিলেন হোমিওপ্যাথিকে সমালোচনা করে। যদিও এর পক্ষে বিপক্ষে নানা কথা উঠেছিল তখন।

ইউরোপের দিকে হোমিওপ্যাথি আসন গাড়ে ১৮ শতকের মাঝামাঝিতে। কিন্তু সেখানে এর রমরমা অবস্থা করতে পারেনি আমেরিকান স্কুলগুলোর মত। ১৮৬৭ সালের দিকে অনেক ফ্রেঞ্চ হোমিওপ্যাথ তাদের প্রাকটিস বন্ধ করে দেন এবং ১৯২০ সালে এসে আমেরিকায় সর্বশেষ হোমিওপ্যাথিক স্কুলটিও বন্ধ হয়ে যায়।

এখানে একটা জিনিস উল্লেখযোগ্য যে, হোমিওপ্যাথি প্রাকটিস যারা করতেন তারা অনেকেই কিন্তু মূলধারার ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু একটা সময়ে এসে তারা যখন বুঝতে পারলেন এই ঔষধ কাজ করে না তখন তারা এটা প্রেস্ক্রাইব করা বন্ধ করে দিলেন। ১৯২০ এর পরে গিয়ে তাই হোমিওপ্যাথির জনপ্রিয়তা আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে।

কারন জরুরী ক্ষেত্রে এই ঔষধ কোন কাজ করে না। হোমিওপ্যাথি খুব ধীরে ধীরে কাজ করত, কারন হোমিওপ্যাথরা বলতেন এই ঔষধ দেহের নিজস্ব ভালো হয়ে যাবার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। আদতেও যা ছিল প্লাসিবো ইফেক্টের ফল। মূলধারার বিজ্ঞান যখনই এনালাইসিস করা শুরু করল তখন থেকেই হোমিওপ্যাথির পতন শুরু হল।

জার্মান নাযীরা হোমিওপ্যাথি পছন্দ করত। কিভাবে হোমিওপ্যাথি কাজ করে সেটা জানার জন্য এবং এর রিসার্চের পেছনে তারা বেশ বড় একটা অংক বিনিয়োগ করে। যদিও অদ্ভুত কারনে তারা পরে পিছিয়ে আসে কোন ধরনের ফলাফল না পেয়েই। আমেরিকায় হোমিওপ্যাথি খুব গভীরে শেকড় গাড়তে না পারলেও ইউরোপে কম প্রভাব বিস্তার করেও এখনো মানুষের মনে হোমিওপ্যাথির জন্য অদ্ভুত একটা সহানুভুতি কাজ করে।

১৯৫০ এর দিকে হোমিওপ্যাথি আমেরিকায় আবার লাইমলাইটে আসতে শুরু করে। এর পেছনের মূল হোতা অবশ্য ধরা হয় তখনকার এক সিনেটরকে। ১৯৩৮ এ করা আইন (Food, Drug, and Cosmetic Act of 1938) যা স্পন্সর করেছিলেন সিনেটর রয়াল কোপল্যান্ড, সেখানে তিনি হোমিওপ্যাথিকে মূলধারার ঔষধের স্বীকৃতি দেন। এই সিনেটর নিজেও কিন্তু একজন হোমিওপ্যাথ ছিলেন।

১৯৫০ এবং ১৯৭০ এর দিকে তাই আমেরিকায় আবার বেশ জোরেসোরে এর চর্চা শুরু হয়। হানিম্যানের মূল থিওরি থেকে সরে এসে অনেকেই দ্রবন নিয়ে বিভিন্ন রকম এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকেন। কেউ কেউ দ্রবনে ঔষধের পরিমান বাড়ান (1X, 2X, 6X)। ফার্মেসীগুলোতেও তখন হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বিক্রি হত। তারা বুঝেছিল এর থেকে প্রচুর লাভ আসে।

আসলে সবই ছিল পয়সা ইনকামের ধান্দা।

হোমিওপ্যাথির কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয় একবিংশ শতাব্দীতে এসে। এই শতকে এসে যখন বিভিন্ন মেটা-এনালাইসিস করা হতে থাকে তখন আসলে দেখা যায় হোমিওপ্যাথি যে সকল অসুখ সারাবার কথা বলে তার কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিভাগ প্রতিবেদন দেয় NHS কে যেন হোমিওপ্যাথিকে কোন ধরনের ফান্ডিং না দেয়া হয়। কারন একটাই এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া, ২০১৯ এ কানাডা সবাই একরকম হোমিওপ্যাথি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফ্রান্স ২০২১ সালের মধ্যে হোমিওপ্যাথির ঔষধ ব্যবহারকারীদের আর কোন ক্ষতিপুরন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফ্রান্স কিন্তু সব থেকে বেশি এই অল্টারনেটিভ ড্রাগ ব্যবহার করত। অন্যান্য দেশের তুলনায় হোমিওপ্যাথির ব্যবহার এখনও পর্যন্ত ফ্রান্সেই বেশি।

বিকল্প ঔষধ আর প্রাকৃতিক উপাদানের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ার কারনেই মূলত হোমিওপ্যাথি এখনো টিকে আছে। আমাদের দেশে ফার্মেসিগুলোতে হোমিওপ্যাথি বিক্রি নাহলেও এখনো এর প্রচুর প্রচলন আছে। আশে পাশে প্রচুর হোমিওপ্যাথ এর দেখা পাবেন। যদিও এদের বেশিরভাগই ডাক্তার নন।

বিগ ফার্মা বনাম হোমিওপ্যাথি

বিগফার্মা কোম্পানি বলতে আসলে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোকেই বোঝানো হয়। অনেক হোমিওপ্যাথি লাভারকে বলতে দেখেছি তারা মনে করেন এই সব বিগফার্মা কোম্পানি গুলো এসেই হোমিওপ্যাথির বারটা বাজিয়েছে। কারন আর কিছুই নয় ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব। যদিও তাদের এই কন্সপাইরেসি থিওরির ভিত্তি খুব দূর্বল। কারন হোমিওপ্যাথি মূলধারার ডাক্তারদের কাছে জনপ্রিয় না হবার কারন এই ঔষধের পিছনে যথেষ্ট রিসার্চ পেপার নেই এবং এর কার্যকারিতা ইমার্জেন্সি ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে।

আমেরিকার কথায় আবার ফেরত যাই, কারন সারা বিশ্বে ঔষধের স্টান্ডার্ড ধরা হয় তাদের নির্দেশিকাকেই। তারা হোমিওপ্যাথি উৎপাদন নিষিদ্ধ করেনি। কিন্তু উৎপাদকদের বলেছে পরিষ্কার ভাবে লেবেলিং করে দিতে যে এই ঔষধ কাজ করে না “no scientific evidence the medicine works”।

অথবা, তারা চাইলে প্রমান করতে কিভাবে এটা কাজ করে। এখন বেশিরভাগ দেশের সরকারই মনে করে হোমিওপ্যাথি আসলে সাপের তেল বিক্রি করার মত একটা তুকতাক।

আদতে আমার কাছে যেটা মনে হয় হোমিওপ্যাথির থেকে ভেষজ চিকিৎসা অনেক বেশি কার্যকর। মানে আমাদের কবিরাজী :)।

১৮০০ শতকের থেকে বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেকদুর এগিয়েছে। চাইলেই কেউ এখন আর অবৈজ্ঞানিক কিছু হুট করে চালিয়ে দিতে পারে না পৃথিবীজুড়ে। কিন্তু তারপরেও আমাদের দেশে ঝাড়ফুঁক আর হোমিওপ্যাথি রয়েই গেছে। কথায় বলে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। ১৫০ বছরে বিজ্ঞানের অনেক চোখ হয়েছে কিন্তু অনেক মানুষের মস্তিষ্ক বেড়ে ওঠেনি।

একটা টার্কিশ প্রবাদ দিয়ে এই প্যাচাল শেষ করি। হোমিওপ্যাথি খাবেন না খাবেন না, সেটা সম্পুর্ন আপনার উপর নির্ভর করে।

“If you take this medicine, you’ll be cured in 7 days. If you don’t take it, you’ll be cured in one week.”

যাদের এত বড় লেখা পড়ার ধৈর্য নেই তারা নিচের ভিডিওটি দেখে নিতে পারেনঃ

2 Comments

  1. Masud rahman মে 9, 2020

মতামত দিনঃ