রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে ঘিরে পরস্পর বিরোধী চিন্তা ও ভাবনা দীর্ঘ দিনের।
কতিপয় সাহিত্যিক ও সমালোচকদের মুখে শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলাম পরস্পর বিরোধী ছিলেন, একে অপরের সমালোচক ছিলেন, একে অপরকে কষ্মিনকালেও সহ্য করতেন না, দুজনের হাতে ছিলো দুধরনের সাম্প্রদায়িকতার ঝান্ডা।
কিছু স্বঘোষিত সাহিত্যিক এটাও প্রচার করেছেন যে, নজরুল ইসলাম নাকি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ষড়যন্ত্র করে নজরুল কে বিষ খাইয়ে অসুস্থ করেছিলেন যাতে নজরুল নোবেল না পান। অন্য আরেক দল রবীন্দ্র বিদ্বেষী, মূর্খ ও সাম্প্রদায়িক সমালোচকরা প্রচার করেছেন, নজরুলের তখন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল তখন রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ সরকারের সাথে লবিং করে নজরুলের নোবেল আটকে দেন, আর রবীন্দ্রনাথ তো ব্রিটিশ দালাল ছিলেন যার ফলে এই কাজটি করতে সুবিধা হয়েছিল তার।
অনেকেই যারা মনে প্রাণে সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করেন তাদের অনুভবে আসা দরকার ছিল যে, একজন ব্যক্তি যদি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে থাকে তাহলে তার অসুস্থতা কি কখনো তার পুরস্কার প্রাপ্তির পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে?
রবীন্দ্রনাথ না হয় ব্রিটিশ সরকারের দালাল ছিলেন, উনি না হয় নিজেই লবিং করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এবং নজরুলের নোবেল আটকে রেখেছেন, কিন্তু সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার কি তখন ইংল্যান্ড দিত? যে সংস্থা থেকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হতো সেটা কি এতই দূর্বল ছিল যে একজন কবির লবিং এ আটকে যেত? আর নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটি যদি স্বেচ্ছায় রবীন্দ্রনাথের মত একজন ব্যক্তির কথায় কাউকে নোবেল দিত বা বাতিল করতো তাহলে কি বিশ্বের অন্যান্য বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক ব্যক্তিরা বসে থাকতেন? এরকম হাজারো প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে নিয়ে।
ওই সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরা জানে কিভাবে মিথ্যা প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে হয়। যারা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন তাদের যদি বলা হয় রবীন্দ্র ও নজরুলের সৃষ্টি কর্ম নিয়ে কিছু আলোচনা করতে তখন তাদের অবস্থা হয় “ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি” এর মত। কিন্তু সমালোচনার সুযোগ পেলেই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে ব্যবহার করে ছড়িয়ে দিবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহৎকবি, বাংলার কবিদের ভেতর তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, বিশ্বসাহিত্যে গীতিকবিতার ক্ষেত্রে এখন ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে লক্ষ্য করবার ব্যপার থাকে যে, নজরুল ও মহৎ এবং বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রতিভা ও অর্জনের দিকে থেকে রবীন্দ্রনাথের পরেই তার স্থান। প্রথম ও দ্বিতীয়র মধ্যে দূরত্ব দূর্লঙ্ঘ। মনে রাখা আবশ্যক যে নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবন ছিল মাত্র ২২ বছরের, রবীন্দ্রনাথের সময়ের তিন ভাগের এক ভাগ।
কিন্তু দুই কবি সবসময়ই পরস্পরের কাছাকাছি ছিলেন এবং সেই নৈকট্য ও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। দুজনেরই প্রধান পরিচয় ছিল তাঁরা কবি। তারা দূজনেই আবার বহুমুখী, সাহিত্যের সব শাখা তেই তাদের কাজ আছে এবং তারা দেশের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সমাজের অগ্রগতি ও মানুষের মুক্তি নিয়ে তাদের চিন্তা ছিল সার্বক্ষণিক। রবীন্দ্রনাথের মত নজরুলের ও ছিলো সঙ্গীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ এবং সঙ্গীতের ক্ষেত্রে দুজনেরই অবদান অসামান্য। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ১৯২০ এর দিকে নজরুলের যখন আগমন তখন রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন তাঁর গৌরবের পূর্নতায়। তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তার প্রভাব সর্বগামী এবং প্রায় সবদিকেই বিস্তৃত। তিনি গুরুদেব, তাকে অতিক্রম করা অসম্ভব। নজরুল ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী ও গভীর ভাবে রবীন্দ্র ভক্ত। রবীন্দ্রনাথের যত উপন্যাস পেয়েছেন তা পড়ার ভেতর দিয়েই নজরুল লেখক হবার প্রস্তুতি নেন।
আর এদিকে …….
নজরুল ইসলাম। নামোচ্চারনের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিশেষন এসে পড়ে জিভের ডগায়। বিদ্রোহী কবি।
তাও না হয় হলো; কিন্তু কেমন চেহারা হতে পারে এঁর? বাঙালি কোন কবির চেহারা যদিবা কল্পনায় আঁকা যায়, যিনি “বিদ্রোহী” তার ছবি কি করে নির্মান করি? আর কোনো বিদ্রোহী কবি নেই চোখের সন্মুখে যে তার প্রতিকৃতিতে অঙ্কন করবো।
নজরুলের ছবি যারা দেখেছেন তাঁরা বলেন, মূর্তিমান যৌবন। অচিন্ত্য কুমার সেন গুপ্ত উজ্জ্বল বর্ননা দিয়েছেন তার কল্লোল যুগ বইতে: –
“যেমন লেখায় তেমনি পোষাকে আশাকে ও ছিল একটি রঙিন উচ্ছৃঙ্খলতা।…… নজরুলের ঔদ্ধত্যের মাঝে একটা কবিতার সমারোহ ছিল, যেন বিহ্বল,বর্ণাঢ্য কবিতা। গায়ে হলুদে পাঞ্জাবি, কাঁধে গেরুয়া উড়ুনি কিংবা পাঞ্জাবি গেরুয়া, উড়ুনি হলদে। বলতেন,আমার সম্ভ্রান্ত হবার দরকার নেই, আমার বিভ্রান্ত করবার কথা। জমকালো পোশাক না পড়লে ভীড়ের মধ্যে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব কি করে? মিথ্যে কথা। পোশাকের প্রগলভতার দরকার ছিলো না নজরুলের। বিস্তীর্ণ জনতার মাঝে ও সহজে চিহ্নিত হতো সে, এত প্রচুর তার প্রান, এত চাঞ্চল্য। সবসময়ে উচ্চরোলে হাসছে ফেটে পড়ছে উৎসাহের উচ্ছলতায়, বড় বড় টানা চোখেমুখে সবল পৌরুষের সঙ্গে শীতল কমনীয়তা। দুরে থাকলে ও মনে করিয়ে দেবে অন্তরের চিরন্তন মানুষ বলে। রঙ শুধু পোশাকে কি? রঙ তাঁর কথায় তার হাসিতে তার গানে অজস্রতায়।” এই-ই নজরুল।
প্রানের উত্তাপে, হৃদয়ের প্রসারে আত্মার ঔদার্যে সব সময়ই অস্থির চঞ্চল। অন্তরে কোন মালিন্য ছিলনা। রেখে ঢেকে কিছু করা বা বলা তার চরিত্রে ছিলনা। যেন এক ঝলক বিদ্যুৎ-সব ই তীক্ষ্ণ, পরিস্কার,অকপট। প্রানের চেয়ে ও বেশি ভালোবাসেন শ্রদ্ধা করতেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। মনে মনে সর্বদাই তাঁর গান গুনগুন করতেন, একবার মাথা ফাটিয়েছিলেন জনৈক ব্যক্তির-সে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তাকে বড় কবি বলেছিল বলে।”
নজরুলের কথায়, “বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয় মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতার পূজা করে। ছেলে বেলা থেকেই তার ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল সন্ধ্যা বন্দনা করেছি। তারপর কতদিন দেখা হয়েছে আলাপ হয়েছে। নিজের লেখা দু’চারটে কবিতা গান শুনিয়েছি…… আমার সৌভাগ্য বশত: কবিগুরুর অতি প্রশংসা লাভ করেছি। সঙ্কোচে দুরে গিয়ে বসলে সস্নেহে কাছে ডেকে বসিয়েছেন। মনে হয়েছে, আমার পূজা সার্থক হলো , আমি বর পেয়েছি।”
নজরুলের সর্বপ্রথম বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহী। সাপ্তাহিক বিজলী তে প্রকাশিত হয়েছে। ঐ সংখ্যা টি বেরুবার দিন সকালে বিজলী অফিসে হাজির হলেন নজরুল। সম্পাদক অবিনাশ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে চার কপি কাগজ নিলেন, বললেন, গুরুজীর কাছে নিয়ে যাচ্ছি। নজরুল চলে গেলেন। কবিতা শুনিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথকে। বিশ্বকবির মুগ্ধ ভক্ত ছিলেন বিদ্রোহী কবি। অন্যদের মতো কখনো গুরুদেব বলেননি, বলতেন গুরুজী, বলতেন আমার গুরু।
বিদ্রোহী কবির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চরিত্র গত ব্যবধান ছিল আকাশ পাতাল। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নজরুলকে, তাই স্নেহ করতেন খুব। ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, নজরুল যদি শান্তি নিকেতনে যানতো বড়োই খুশি হবেন; নজরুল গান শিখবেন দীনেন্দ্র নাথ ঠাকুরের কাছে,আর শান্তি নিকেতনের ছেলেদের একটু-আধটু ড্রিল শেখাবেন। হাজার হোক সৈনিক কবি তো! নজরুল গিয়েওছিলেন শান্তি নিকেতনে, সঙ্গে ছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। দু’জনে পূজার ছুটি কাটিয়ে এলেন এরপর প্রায় বৎসর খানেক পরে নজরুল ইসলাম একটি পত্রিকা বের করেছিলেন, অর্ধসাপ্তাহিক, নাম রেখেছিলেন ধূমকেতু। পত্রিকা প্রকাশের সব ঠিকঠাক। নজরুল শেষ মুহূর্তে টেলিগ্রাফ পাঠালেন তাঁর গুরুজীর কাছে আর্শীবানী চেয়ে। তড়িৎ এল উত্তর, একটি কবিতা:
কাজী নজরুল ইসলাম
কল্যাণীয়েসু-
আয় চলে আয়রে ধুমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষনের তিলক-রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দে রে ডঙ্কা মেরে’
আছে যারা অর্ধ-চেতন।
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২৪শে শ্রাবণ ১৩৩৯
কবিগুরুর আশীর্বাদ ব্লক করে ছাপা হলো প্রথম পৃষ্ঠায়।
ধুমকেতু পূর্ণ বিক্রমে পাঁচ মাস বেরিয়ে ছিল। তার পর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে কারারুদ্ধ করা হলো নজরুল কে। বিচারে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।
নজরুল তখন প্রেসিডেন্সি জেলে। রবীন্দ্র নাথের নতুন একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হলো: বসন্ত। ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯২৩ বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হবে এ্যলফ্রেড থিয়েটারে। বসন্ত গীতিনাট্য সেখানেই পরিবেশিত হবে। কবি ভুলে যাননি তাঁর স্নেহ ভাজন অনুজ কবিকে, কাব্যটি উৎসর্গ করলেন শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু-কে। নজরুল বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় জেলের মধ্যে পৌঁছিয়ে দিয়ে এলেন কবিগুরুর উপহার।
এরপর হঠাৎ একদিন শোনা গেল , নজরুল অনশন ধর্মঘট করছেন। ইতোমধ্যে হুগলি জেলে সরিয়ে নেয়া হয়েছে তাকে। উৎকন্ঠিত রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম করলেন: Give up hunger-strike our literature claims you. হুগলি জেলের সংবাদ কবি জানতেন না। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে টেলিগ্রাম ফেরত এল, Address not found– লোক খুঁজে পাওয়া গেলো না।
কয়েক বৎসর পরে আরেক টি পত্রিকা বের করলেন নজরুল – “লাঙ্গল“। এবার ও রবীন্দ্রনাথ প্রচ্ছদ পটের জন্য দু’পংক্তি লিখে দিলেন:
“ধরহাল বলরাম আন তবে মরু-ভাঙ্গা হল
বল দাও ফল দাও স্তব্ধ হোক ব্যর্থ কোলাহল।”
বিদ্রোহী কবির জন্য দ্বার অবারিত ছিল সর্বদা।
পরিতাপের বিষয়, এখন অনেকে নজরুলের রবীন্দ্রনাথকে সমকক্ষ বানিয়ে ফেলেছেন। এবং অনেকে বাংলা সাহিত্যে নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী ও বানিয়ে ফেলেছেন। অথচ তাদের বাস্তব জীবনের গল্প ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। রবীন্দ্র ও নজরুলের সম্পর্ক ছিল খুব রসালো ও মধুর। কিন্তু আমাদের বঙ্গদেশীয় সাহিত্য বিশারদ গন এই দুই গুরু শিষ্যকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পরস্পর বিরোধী রুপে।
ভাবতে অবাক লাগে যে কিভাবে এত গুজব ছড়াতে পারে ও বিশ্বাস করে! আমাদের বাঙালি সাহিত্য বিশারদরা সঠিক ভাবে নাজানে নজরুল কে না জানে রবীন্দ্রনাথকে। এখানে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্কে যত কিছু বলা হয়েছে এসব কিছুই আমাদের তথাকথিত সাহিত্য বিশারদ দের কানে যাবে না। তারা শুধু প্রোপাগান্ডা ছড়াবে নষ্ট করবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কিন্তু তারা একটু খোঁজ খবর ও নেননা যে বাস্তবিক জীবনে কেমন সম্পর্ক ছিল এই দুই কবির। এখন যদি নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেন তাহলে কি বলতেন এইসব অশ্লীলতা দেখে?
শিবব্রত চক্রবর্ত্তী