১৯৬৪ সালে সোভিয়েত এস্ট্রোনমার নিকোলাই কারদাশেভ প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতার উপর সভ্যতার একটা স্কেল বানান। তিনি প্রস্তাব করেন শক্তি (energy) ব্যবহারের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে মহাবিশ্বের সভ্যতাকে তিন ভাগে ভাগ করা যাবে টাইপঃ ১,২, এবং ৩।
টাইপ-১, এই সভ্যতার প্রানীরা তাদের গ্রহের সকল শক্তির উৎস এবং খনিজ আহরন ও ব্যবহারে সক্ষম হবে।
টাইপ-২, সভ্যতার প্রানিরা তাদের গ্রহ ছাড়িয়েও তাদের প্লানেটরি স্টার (যেমন আমাদের সূর্য) এর সকল শক্তি এবং সেই সিস্টেমের বাকি গ্রহগুলো থেকে প্রাপ্ত খনিজ এবং শক্তিও আহরন করতে পারবে।
টাইপ-৩, সভ্যতা আরো উন্নত হবে প্রযুক্তিতে। এরা পুরো একটা গ্যালাক্সির শক্তি আহরন করতে পারবে। স্পেস টাইম তাদের কাছে নস্যি একটা বিষয়।
কার্দাশেভের এই স্কেল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এখনও পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য মডেল হিসেবে ধরা হয় মহাবিশ্বের সভ্যতাগুলকে শ্রেনীবিভাগ করতে।
তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রি-ম্যান ডাইসন ১৯৬০ সালে বলেছিলেন মধ্যম শক্তির ইনফ্রারেড (IR) রেডিয়েশন থেকে এই ধরনের সভ্যতাগুলোকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
আর জেনে অবাক হবেন, মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ৯৩ টি গ্যালাক্সী কেন্দ্রিক সভ্যতা আছে বলে ধারনা করছেন। পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের (Penn State University) রজার গ্রিফিথ (Roger Griffith) এবং তার সহকর্মীরা প্রায় লক্ষাধিক বস্তুর তথ্য বিশ্লেষন করে ২০১৫ সালে এরকম একটা ক্যাটালগ প্রকাশ করেন।
তারা দেখেন অনেকগুলো গ্যালাক্সি থেকেই এই ইনফ্রারেড রেডিয়েশন আসছে। তবে এটা নিশ্চিতভাবে কখনই বলা যাবে না, এই রেডিয়েশন কৃত্তিম নাকি প্রাকৃতিকভাবেই (মহাজাগতিকভাবে) সৃষ্টি হচ্ছে।
আর এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় আমাদের চেনা মহাবিশ্বের কোথাও টাইপ-৩ সভ্যতার অস্তিত্ব নেই। কাজেই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন। এলিয়েনরা সহসাই পৃথিবী বা সৌরজগত আক্রমন করছে না 🙂
আপনি জানেন কি, কার্দাশেভ স্কেলে আমরা এখনও টাইপ-১ সভ্যতা-ও হতে পারিনি। মনে হয়ে শুন্যেরও নিচে মাইনাস তিন-চারে থাকব। টাইপ-১ এর সভ্যতা হতে গেলে আমাদের পাড়ি দিতে হবে আরো অনেকটা সময়।
পৃথিবীর বাইরে প্রানের অস্তিত্ব আদৌ কি আছে?
১৯৫০ এর গ্রীষ্মকাল, পদার্থ বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি দুপুরের খাবার খেতে খেতে তার কলিগদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মনে কি কখনো প্রশ্ন জেগেছে, সবাই কোথায়?”
তিনি আসলে এলিয়েনদের ব্যাপারে জানতে চাইছিলেন। যদি সাড়ে চার বিলিয়ন বছর শেষে মানুষের একটা প্রজাতি মহাকাশ ভ্রমনে সক্ষমতা অর্জন করে তবে আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সির অন্যান্য জায়গাতেও একই রকম হবার কথা। ভিনগ্রহের প্রানি দিয়ে মিল্কিওয়ে গিজগিজ না করলেও চার পাঁচটা সভ্যতার সাথে অন্তত আমাদের ইতিমধ্যে দেখা হবার কথা ছিল।
কিন্তু এত খোঁজাখুঁজির পরেও আমরা এখনো কোন ধরনের শক্ত প্রমান পাইনি যাতে বলা যায় পৃথিবীর বাইরেও প্রানের অস্তিত্ব আছে। হিসেবের কোথাও একটা গড়মিল হচ্ছে।
মহাবিশ্বের স্থান-কালের এই বিশালত্ব থাকা সত্ত্বেও প্রানের অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়াটাকেই তাই ফার্মি প্যারাডক্স বলা হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানী ফার্মির এই প্যারাডক্সের ব্যাখ্যা নানাজনে নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছন।
এলান স্টার্ন এর ব্যাখ্যাঃ
প্লানেটারি সায়েন্টিস্ট এলান স্টার্ন -এর মতে, কোন গ্রহে প্রানের অস্তিত্ব থাকার জন্য যে জিনিসগুলোর দরকার হয় তার মাঝে সমুদ্র থাকা এবং পানি থাকা জরুরী বলে আমরা মনে করি। আমাদের পৃথিবীর দিকেই তাঁকিয়ে দেখুন, আমাদের কি বিশাল সমুদ্র রয়েছে। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় তিনভাগ পানি দিয়ে ঢাকা।
যদি অন্য গ্রহগুলোতে, যেখানে আমরা প্রানের অস্তিত্ত্ব খুঁজছি, সেখানেও একইরকম ভাবে সমুদ্র ভূ-পৃষ্ঠের উপর থেকে থাকে তবে আপনি সেখানে প্রানের সন্ধান খুঁজে পেতে পারেন।
কিন্তু আমার মনে হয়, আমাদের গ্যালাক্সির বেশিরভাগ গ্রহেই সমুদ্র ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে নয়, বরঞ্চ নীচে। তাদের সমুদ্র ঢেকে আছে মোটা বরফ আর শিলার আড়ালে। যদি সেরকম হয়ে থাকে তবে বুদ্ধিমান প্রানের উদ্ভব হলেও আমরা তাদের শহরের আলোগুলো দেখতে পাবো না। এমনকি তারা কখনও জানতেও পারবে না বাইরে একটা পুরো মহাবিশ্ব রয়েছে। টেকনোলোজিতে অনেক এগিয়ে থেকেও তারা কখনোই মহাকাশযান বানাবে না, যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না অন্য গ্রহের প্রানের সাথে।
বিজ্ঞানী এলান স্টার্নের এই ব্যাখ্যা ফার্মি প্যারাডক্সের একটা দিক ব্যাখ্যা করলেও, অন্যদিক একটা দিক এড়িয়ে গেছে। সেটা হল, পৃথিবীতে পানি কিন্তু সৃষ্টিকাল থেকেই ছিল না। বরঞ্চ পৃথিবী তৈরি হবার পরে মহাজাগতিক উল্কাপিন্ডই পৃথিবীতে পানি নিয়ে এসেছে। সে হিসেবে একই রকমভাবে অন্যগ্রহেও পানি বা বরফপিন্ডের পৌঁছে যাবার কথা।
ফার্মি প্যারাডক্সের আরেকটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, প্রানের উদ্ভব আমাদের আগেই হয়েছে অন্যকোনও জায়গায়, এবং পৃথিবী তৈরির আগেই তা আবার ধ্বংসও হয়ে গেছে। সে হিসেবে আমাদের চলে যাবার পরেও আরো প্রানের উদ্ভব হবে এবং আমাদের সাথে তাদের দেখাও হবে না। মহাবিশ্বের সৃষ্টির স্থান-কাল বিবেচনায় তা খুবই সম্ভব।
আর মানুষের থেকে অনেক অনেক বুদ্ধিমান প্রানের অস্তিত্ব যদি থেকেও থাকে তবে হয়ত তারা ইচ্ছে করেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করেনি। যেমনটা আমরা চলতি পথে পিপড়ার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনা।
সভ্যতার বিচারে হয়ত আমরা এতটাই নগন্য যে আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চিন্তাই তারা করেনি।
মানব সভ্যতা কতদূর যাবে?
সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে কি না, তা মাপার একটা পদ্ধতি হল ভাষা। টাইপ-১ সভ্যতার ভাষা একই রকম হবে। আমরা ইন্টারনেটের যুগে সেদিকেই যাচ্ছি আস্তে আস্তে। পৃথিবীর যেখানেই যান দেখবেন সবাই ইংরেজীর একটা শব্দ হলেও বোঝে।
ইংরেজী এখন পৃথিবীর জন্য ২য় ভাষা হয়ে গেছে। প্রথমটি হচ্ছে যার যার আঞ্চলিক ভাষা। এই সার্বজনীনতাই প্রমান করে সভ্যতা কতটুকু আগাচ্ছে।
এখানে নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতির প্রতিযোগীতার থেকে বেশি বোঝা দরকার পৃথিবী কেন্দ্রিক সভ্যতা আর সংস্কৃতিকে।
যেমনঃ পৃথিবী জুড়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল অথবা বর্তমানের মোবাইল আর পিসি গেইমিং। এটা পুরো পৃথিবীর কালচার এর প্রতিনিধিত্ব করে। সব দেশেই এটা সার্বজনীন, একইরকম।
ধর্মীয় মৌলবাদ, আঞ্চলিক স্বার্থ আর কাল্পনিক বর্ডার কেন্দ্রিক যে দেশের ধারনা তা যেদিন বিলুপ্ত হবে মানব সভ্যতা সেদিন টাইপ-১ এর দিকে আরো এগিয়ে যাবে।
একথা নিশ্চিত ভাবে বলা না গেলেও, ধারনা করা হয় আমাদের গ্যালাক্সিতেই টাইপ-১ সভ্যতায় পৌছানোর আগেই অনেক গ্রহের পুরোটাই বিলীন হয়ে গেছে প্রজাতি সহ।
সে হিসেবে আমাদের উচিত এমন একটা প্রজাতিতে রুপান্তরিত হওয়া যারা দুই গ্রহে বসবাস করে।