।। এক ।।
২১শে মে, ২০৬১। মানব সভ্যতা যখন কার্দাশভ স্কেলে টাইপ-১ থেকে টাইপ-২ এর দিকে যাত্রা শুরু করেছে, ঠিক তখনই, খানিকটা কৌতুক করতে গিয়েই এই প্রশ্নের শুরু।
গল্পের শুরুটা সামান্য পাঁচ ডলারের বাজিকে ঘিরে। এক পানশালার আড্ডায় পানপাত্র হাতে নিয়ে। ঘটনাটা অনেকটা এরকম:
আলেকজান্ডার অ্যাডল আর বার্ট্রাম লুপোভ—দুজনেই ছিল ‘মাল্টিভ্যাক’- এর টেকনিশিয়ান। রক্তমাংসের মানুষ হয়ে ঠিক যতটুকু জানা সম্ভব, শুধু ততটাই ওরা জানত। এই অতিকায় কম্পিউটারের হিমশীতল, ঝকঝকে, খটখটে মুখের আড়ালে যে মাইলের পর মাইল যন্ত্রপাতির জঙ্গল, তার কিছুটার খবর ওরা রাখত। রিলে আর সার্কিটের সেই বুনোট কবেই মানুষের একক বুদ্ধির নাগাল ছাড়িয়ে গেছে!
মাল্টিভ্যাক কম্পিউটার নিজেই নিজেকে সামলাতো, নিজের ভুল শুধরে নিত। না নিয়ে উপায়ও ছিল না। মানুষের পক্ষে অত দ্রুত, অত নিখুঁতভাবে এই কাজ করা সাধ্যের বাইরে। তাই অ্যাডল আর লুপোভের কাজ ছিল শুধু সেই বিশাল কম্পিউটারের উপর নজর রাখা – মানুষের পক্ষে যতটুকু সম্ভব। ওরা তথ্য জোগাত, প্রশ্নগুলোকে যন্ত্রের উপযোগী করে সাজিয়ে দিত, আর যন্ত্রের দেওয়া উত্তরের মানে বের করত। মাল্টিভ্যাকের সাফল্যকে অবশ্য ওরা নিজেদের সাফল্য বলেই ধরে নিত।
কয়েক দশক ধরে এই মাল্টিভ্যাকই তো মহাকাশযানের নকশা বানাচ্ছে, মহাকাশ যাত্রার নিখুঁত পথ বাতলে দিচ্ছে। মানুষ তার হাত ধরেই পৌঁছেছে চাঁদ, মঙ্গল আর শুক্রে। কিন্তু দৌড় ওই পর্যন্তই। পৃথিবীর জ্বালনী যা ছিল, তাতে এর বেশি কুলোয়নি। দূরপাল্লার মহাকাশ যাত্রায় যে বিপুল শক্তি লাগে, তা পৃথিবীর ছিল না। কয়লা আর ইউরেনিয়ামের শেষ অণু পর্যন্ত ব্যবহার করেও দেখা গেল, দূরপাল্লার মহাকাশযাত্রা মানুষের জন্য অসম্ভব।
কিন্তু মাল্টিভ্যাক শিখছিল। ধীরে ধীরে সে আরও গভীর, আরও মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করল। অবশেষে, ২০৬১ সালের ১৪ই মে, যা ছিল শুধুই কাগুজে গণিতের ভাষা, তা হয়ে উঠল জলজ্যান্ত বাস্তব।
সরাসরি সূর্যের শক্তিকে সংরক্ষন করে, তাকে বদলে নেওয়া আর ইচ্ছেমতো ব্যবহার করার কৌশল মানুষ জেনে ফেলল। টাইপ-১ থেকে টাইপ-২ সভ্যতায় উত্তরণ ঘটল মানুষের। গোটা পৃথিবী এক সাথে বন্ধ করে দিল তার কয়লা আর পারমাণবিক চুল্লিগুলো। একটামাত্র সুইচ চেপে মানুষ জুড়ে গেল এক চিলতে একটা স্টেশনের সাথে – চাঁদের অর্ধেক দূরত্বে পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে এক মাইল ব্যাসের সেই স্টেশন। অদৃশ্য সৌরশক্তির স্রোতে ভেসে গেল পুরো মানব সভ্যতা।
সাত-সাতটা দিন কেটে গেলেও সেই সাফল্যের ঘোর কাটেনি। অ্যাডল আর লুপোভ সেই প্রথম একটু অবসর পেল। সমস্ত উৎসব-আয়োজন, লোকদেখানো হইচই থেকে পালিয়ে ওরা দুজনে এসে বসল একটু নির্জনে। মাটির তলার এই পরিত্যক্ত ঘরগুলোতে কেউ তাদের খুঁজতে আসবে না। এখান থেকে দেখা যায় মাল্টিভ্যাকের ঘুমন্ত, সমাধিস্থ শরীরের কিছু অংশ।
আজকে যন্ত্রদানবও যেন ছুটিতে। দেখাশোনার কেউ নেই। অলস ছন্দে খটখট শব্দ তুলে সে শুধু নিজের মনে তথ্য গোছাচ্ছে। এই বিশ্রামটুকু প্রাপ্য ছিল তার সুপার কম্পিউটারের। টেকনিশিয়ান দুই বন্ধু সেটা জানত। বিশাল কম্পিউটারকে বিরক্ত করার কোনো ইচ্ছে নিয়ে আজকে তারা এখানে আসেনি।
সাথে একটা মদের বোতল এনেছিল ওরা। এই মুহূর্তে, এই নিরালায়, একে অপরের সঙ্গ আর তরল অমৃত – এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার নেই।
“ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়,” অ্যাডেল বলল। তার চওড়া মুখে ক্লান্তির ছাপ। কাচের রড দিয়ে সে ধীরেসুস্থে নিজের পানীয় নাড়ছিল, দেখছিল বরফের টুকরোগুলো কেমন অলসভাবে ঠোকাঠুকি খাচ্ছে। “চিন্তা করে দ্যাখো, আমাদের যত শক্তি লাগতে পারে এখন থেকে সব বিনামূল্যে পাবো! ইচ্ছে করলে এই শক্তি দিয়ে আমরা পুরো পৃথিবীকে গলিয়ে লোহার একটা ফুটন্ত টুকরো বানিয়ে ফেলতে পারি, তবু এতটুকু শক্তির অভাব হবে না। অফুরন্ত শক্তি… চিরকালের জন্য। অনন্ত, অসীম।”
লুপোভ মাথাটা একপাশে কাত করল। তর্কের মুডে থাকলে ও ঠিক এই ভঙ্গিটা করে। আর এখন ও তর্কের মুডেই ছিল। খানিকটা হয়তো এইজন্য যে, বরফ আর গ্লাসগুলো ওকে বয়ে আনতে হয়েছে। “অনন্তকাল নয়।”
“আরে ধুর! অনন্তকালই তো। যতদিন না সূর্যটা নিভছে, বার্ট।”
“সেটা অনন্তকাল হলো না।”
“আচ্ছা, বাবা! লক্ষ কোটি বছর। ধরো, হাজার কোটি বছর। এবার ঠিক আছে?”
লুপোভ তার পাতলা হয়ে আসা চুলে আঙুল চালিয়ে নিজেকে আশ্বস্ত করল যে কিছু এখনও বাকি আছে। গ্লাসে আলতো একটা চুমুক দিয়ে বলল, “হাজার কোটি বছরও অনন্তকাল নয়।”
“আরে, আমাদের জীবনটা তো কেটে যাবে, নাকি?”
“সে তো কয়লা-ইউরেনিয়াম দিয়েও কেটে যেত।”
“তা যেত। কিন্তু এখন আমরা যেকোন স্পেসশিপকে ওই সোলার স্টেশনের সাথে জুড়ে দিতে পারি। জ্বালানির চিন্তা না করে দশ লক্ষ বার প্লুটো ঘুরে আসতে পারবে আমাদের মহাকাশযানগুলো। ঙ্গুলোবা ইউরোনিয়াম দিয়ে এটা হতো? বিশ্বাস না হলে মাল্টিভ্যাককে জিগ্যেস করো।”
“জিগ্যেস করার দরকার নেই। আমি জানি।”
“তাহলে মাল্টিভ্যাকের কৃতিত্বকে ছোট করছ কেন?” অ্যাডেল এবার একটু তেতে উঠল। “ও যা করেছে, দুর্দান্ত করেছে।”
“আমি কখন বললাম দুর্দান্ত করেনি? আমি শুধু বলছি, সূর্য চিরকাল জ্বলবে না। ব্যস। আমরা হাজার কোটি বছরের জন্য নিশ্চিন্ত, কিন্তু তারপর? তারপর কী?” লুপোভের সামান্য কাঁপা আঙুলটা অ্যাডেলের দিকে তাক করা। “আর এটা বোলো না যে তখন আমরা অন্য কোনো সূর্য খুঁজে নেব।”
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। অ্যাডেল মাঝে মাঝে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। লুপোভের চোখ দুটো ধীরে ধীরে বুজে আসছে।
হঠাৎ লুপোভের চোখ দুটো খুলে গেল। “তুমি ঠিকই ভাবছিলে, যে এই সূর্যটা ফুরোলে আমরা অন্য সূর্যে চলে যাব… তাই না? “
“আমি কিছু ভাবছিলাম না।”
“একশবার ভাবছিলে। তোমার যুক্তির গোড়াতেই গলদ। তুমি হচ্ছ সেই গল্পের লোকটার মতো, যে হঠাৎ বৃষ্টি আসায় দৌড়ে একটা গাছের তলায় দাঁড়াল। সে নিশ্চিন্ত ছিল, কারন ভেবেছিল, একটা গাছ ভিজে গেলে না হয় পাশের আরেকটা গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াবে!”
“বুঝেছি,” অ্যাডেল বলল। “চেঁচিও না। যখন আমাদের সূর্য ফুরোবে, অন্য তারাও ফুরিয়ে যাবে।”
“ঠিক ধরেছ,” লুপোভ বিড়বিড় করল। “বিগব্যাং থেকে সবকিছুর শুরু হয়েছে, আবার সব তারা নিভে গেলে সবকিছুর শেষ। কোনটা আগে যাবে, কোনটা পরে। ওই বিশাল তারাগুলো তো দশ কোটি বছরও টেকেনি। আমাদেরটা টিকবে হাজার কোটি বছর, আর ওই খুদে বামন তারাগুলো হয়তো বিশ হাজার কোটি বছরও টিকবে না – তাতে কার কী! কিন্তু মোদ্দা কথা, এক ট্রিলিয়ন বছর পর সব অন্ধকার। এনট্রপিকে (Entropy) বাড়তেই হবে, এটাই নিয়ম। সবকিছুকে ক্ষয়ে যেতেই হবে।”
“এনট্রপি-ফেনট্রপি সেসব আমি জানি,” অ্যাডেল ভাব দেখাল।
“কচু জানো।”
“তোমার চেয়ে কম জানি না।”
“তাহলে এটাও জানো যে একদিন সব কিছু ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
“তা যাবে। কে না করছে?”
“তুমিই তো করছিলে! তুমিই তো বললে ‘অনন্তকাল’!”
এবার অ্যাডেলের পালা। সে উল্টো তর্ক জুড়ল। “হয়তো আমরা কোনো একদিন সবকিছু আবার নতুন করে বানাতে পারব।”
“কখনোই না।”
“কেন নয়? কোনো একদিন…”
“কখনোই না।”
“জিজ্ঞেস করো মাল্টিভ্যাককে।”
“তুমি করো। সাহস থাকে তো তুমিই জিজ্ঞেস করো। পাঁচ ডলার বাজি, ও বলবে সম্ভব নয়।”
অ্যাডেল ঠিক ততটাই মাতাল ছিল যে বাজিটা লড়তে পারে, আবার ঠিক ততটাই সজাগ ছিল যে প্রশ্নটা গুছিয়ে করতে পারে। প্রশ্নটাকে যদি মানুষের ভাষায় সাজানো যেত, তবে তা হতো এইরকম: “মানুষ কি পারবে কোনো একদিন, কোনো বাড়তি শক্তি খরচ না করেই, বুড়িয়ে যাওয়া মৃত সূর্যকে তার পূর্ণ যৌবনে ফিরিয়ে আনতে?“
অথবা, আরও সহজ করে বললে: “কীভাবে এই মহাবিশ্বের মোট এনট্রপিকে বিপুল পরিমাণে কমানো সম্ভব?”
সুপার কম্পিউটারকে প্রশ্নটা করা হলো।
মাল্টিভ্যাক পলকে নিথর, নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আলোর ঝিকিমিকি থেমে গেল, রিলেগুলোর খটখট আওয়াজ গেল মিলিয়ে।
তারপর, ঠিক যখন ওই দুই আতঙ্কিত টেকনিশিয়ান দমবন্ধ হয়ে মরার উপক্রম, তখনই মাল্টিভ্যাকের সাথে লাগানো টেলিটাইপ যন্ত্রটা সশব্দে জেগে উঠল। তাতে ফুটে উঠল কয়েকটি শব্দ:
এই উত্তর দেবার মত পর্যাপ্ত তথ্য আমার কাছে নেই।
“বাজিটা তোলা রইল,” লুপোভ ফিসফিস করে বলল। মাল্টিভ্যাক আবার সচল হয়েছে জেনে ধড়ে প্রান ফিরে এল দুই মাতালের। ওরা তড়িঘড়ি সেখান থেকে সরে পড়ল।
পরদিন সকালে, যখন ঘুম ভাঙল, তখন হ্যাংওভারের মাথা ব্যাথা আর শুষ্ক মুখে রাতের সেই ঘটনার কথা বেমালুম ভুলে গেছে দুজনেই।
।। দুই ।।
জেরোড, জেরোডাইন, আর তাদের দুই কন্যা – জেরোডেট ওয়ান এবং টু – ভিডিওস্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছিল। সময় সংকোচন করে এক লাফে হাইপারস্পেস পার হতেই দৃশ্যপট বদলে গেছে। এতক্ষণ যে তারার মিহি গুঁড়ো চারদিকে ছড়ানো ছিল, তা সরে গিয়ে ফুটে উঠল একটামাত্র উজ্জ্বল চাকতি। ঠিক যেন একটা মার্বেল, পর্দার ঠিক মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে।
“ওই হলো এক্স-২৩,” জেরোড আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল। তার সরু হাত দুটো পিঠের আড়ালে শক্ত করে ভাঁজ করা, আঙুলের গাঁটগুলো উত্তেজনায় সাদা।
ছোট্ট জেরোডেটরা জীবনে এই প্রথম হাইপারস্পেস পার হলো। এক মুহূর্তের জন্য পেটের ‘ভেতর-বাইরে’ যে ওলটপালট হওয়ার অদ্ভুত অনুভূতিটা হলো, তাতে ওরা খানিকটা অপ্রস্তুত। ওরা খিলখিল করে হেসে উঠল, তারপর চিৎকার করতে করতে মায়ের চারপাশে দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিল, “আমরা এক্স-২৩ পৌঁছে গেছি… আমরা এক্স-২৩ পৌঁছে গেছি… আমরা…”
“চুপ করো, বাচ্চারা,” জেরোডাইন কড়া গলায় বলল। “জেরোড, তুমি ঠিক জানো তো?”
“ভুল হবার সম্ভাবনা নেই।” জেরোড ছাদের ঠিক নিচ দিয়ে চলে যাওয়া মসৃণ ধাতব দণ্ডটার দিকে তাকাল। ওটা ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত লম্বা, দেয়াল ফুঁড়ে দুদিকে চলে গেছে। পুরো মহাকাশযান জুড়েই সেটা ছড়ানো।
এই পুরু ধাতব দণ্ডটা নিয়ে জেরোড বিশেষ কিছুই জানত না। শুধু জানত, এর নাম ‘মাইক্রোভ্যাক’। ইচ্ছে হলে একে প্রশ্ন করা যায়; না করলেও ক্ষতি নেই। সে ঠিকই মহাকাশযানকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেবে, মহাজাগতিক শক্তি-কেন্দ্রগুলো থেকে রসদ জোগাড় করে নেবে, আর হাইপারস্পেসে লাফ দেওয়ার জটিল হিসাব নিকাশ নিজে নিজে করে ফেলতে পারে।
জেরোড আর তার পরিবারের কাজ বলতে শুধু এই আরামদায়ক কেবিনে অপেক্ষা করা আর বেঁচে থাকা। জেরোডকে কে যেন একবার বলেছিল, ‘মাইক্রোভ্যাক’-এর ‘এসি’ (ac) শব্দটা নাকি প্রাচীন ইংরেজিতে ‘অটোমেটিক কম্পিউটার‘-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। যদিও সেকথা সে প্রায় ভুলতে বসেছে।
ভিডিওস্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে জেরোডাইনের চোখ দুটো ভিজে এলো। “জানি না কেন, কিন্তু পৃথিবীটার জন্য বড্ড মন কেমন করছে।”
“আরে ছাড়ো তো!” জেরোড ধমকে উঠল। “কী ছিল ওখানে আমাদের? এক্স-২৩-তে আমরা সব পাব। আর তুমি ওখানে একা যাচ্ছ না। তোমাকে পথপ্রদর্শকের মতো গিয়ে জঙ্গল সাফ করতে হবে না। ওই গ্রহে এর মধ্যেই দশ লক্ষের বেশি লোক আছে। আরে, আমাদের নাতি-নাতনিদেরই হয়তো নতুন গ্রহ খুঁজতে হবে, কারণ এক্স-২৩ ততদিনে জনারণ্যে পরিনত হবে।” তারপর একটু ভেবে যোগ করল, “বিশ্বাস করো, এটা মানুষের অনেক ভাগ্যের ব্যাপার যে কম্পিউটারগুলো এই মহাকাশ ভ্রমণের উপায়টা বের করেছে। যেভাবে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে…!”
“জানি, আমি সব জানি, তবুও…” জেরোডাইন বিষণ্ণভাবে বলল।
জেরোডেট ওয়ান সাথে সাথে বলে উঠল, “আমাদের মাইক্রোভ্যাকটা হলো পৃথিবীর সেরা মাইক্রোভ্যাক।”
“আমিও তাই ভাবি,” জেরোড মেয়ের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল।
নিজের একটা ব্যক্তিগত মাইক্রোভ্যাক থাকা—আহ্, কী দারুণ অনুভূতি! জেরোড খুব খুশি যে সে এই প্রজন্মে জন্মেছে। তার বাবার ছোটবেলায় কম্পিউটার মানেই ছিল বিশাল বিশাল যন্ত্র, একেকটা একশো বর্গমাইল জায়গা জুড়ে থাকত। প্রতি গ্রহে থাকত মোটে একটা করে। লোকে বলত ‘প্ল্যানেটারি এসি’। হাজার বছর ধরে ওগুলো কেবল আকারেই বড় হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ একদিন এলো কোয়ান্টাম যুগ। ট্রানজিস্টরের জায়গা নিল আণবিক ভাল্ভ। ফলাফল? বিশাল আকারের একটা ‘প্ল্যানেটারি এসি’-কেও এখন একটা মহাকাশযানের অর্ধেক জায়গায় ভরে ফেলা যায়।
যখনই জেরোডের মনে হতো যে তার এই ব্যক্তিগত মাইক্রোভ্যাকটি সেই আদিম ‘মাল্টিভ্যাক’-এর (যে প্রথম সূর্যকে বশে এনেছিল) চেয়েও লক্ষ গুণ জটিল, আর পৃথিবীর সেই ‘প্ল্যানেটারি এসি’-র (যে প্রথম হাইপারস্পেস ভ্রমণের রহস্য ভেদ করেছিল) প্রায় সমান ক্ষমতাশালী, তখন তার বুকটা গর্বে ফুলে উঠত।
“কত তারা, কত গ্রহ,” জেরোডাইন দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সে নিজের ভাবনায় ডুবে আছে। “আমার মনে হয়, আমাদের মতো পরিবারগুলোকে এভাবেই বোধহয় চিরকাল নতুন নতুন গ্রহে পাড়ি দিতে হবে।”
“চিরকাল নয়,” জেরোড হাসল। “একদিন এই সব থামবে। তবে সে বহু, বহু কোটি বছর পর। তারাও তো ফুরিয়ে যায়, জানো না? এনট্রপিকে যে বাড়তেই হবে।”
“এনট্রপি কী, বাবা?” জেরোডেট টু চেঁচিয়ে উঠল।
“এনট্রপি হলো গিয়ে, মা…, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা যে ফুরিয়ে যাচ্ছে, সেটা মাপার একটা শব্দ। সবকিছুই তো একসময় ফুরিয়ে যায়, তাই না? তোমার ওই খেলনা রোবটটার মতো, মনে নেই?”
“তাহলে তুমি আমার রোবটটার মতো ওতে নতুন ব্যাটারি ভরে দিতে পারো না?”
“মারে, তারা-ই তো হলো ব্যাটারি। ওগুলো একবার ফুরিয়ে গেলে, আর কোনো ব্যাটারিই থাকবে না।”
জেরোডেট ওয়ান সাথে সাথে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। “ওদের ফুরিয়ে যেতে দিও না, বাবা। তারাগুলোকে ফুরিয়ে যেতে দিও না।”
“এই দেখো, কী করলে!” জেরোডাইন ফিসফিস করে স্বামীকে বকা দেয়।
“আমি কী করে জানব যে ওরা এতে ভয় পেয়ে যাবে?” জেরোডও ফিসফিস করে জবাব দিল।
“মাইক্রোভ্যাককে জিজ্ঞেস করো,” জেরোডেট ওয়ান কাঁদতে কাঁদতে বলল। “ওকে জিজ্ঞেস করো, কী করে তারাগুলোকে আবার জ্বালানো যায়!”
“জিজ্ঞেস করোই না,” জেরোডাইন বলল। “তাহলে যদি বাচ্চারা থামে।” (জেরোডেট টু-ও ততক্ষণে কান্না জুড়েছে।)
জেরোড কাঁধ ঝাঁকাল। “আচ্ছা, আচ্ছা, সোনামণিরা। আমি মাইক্রোভ্যাককে জিজ্ঞেস করছি। চিন্তা নেই, ও ঠিক বলে দেবে।”
সে মাইক্রোভ্যাককে প্রশ্নটা করল, আর চট করে যোগ করল, “উত্তরটা ছেপে দাও।”
জেরোড পাতলা সেলোফিল্ম খন্ডটা হাতে নিয়ে হাসিমুখে বলল, “এই দেখো! মাইক্রোভ্যাক বলেছে, সময় হলে ও সবকিছুর খেয়াল রাখবে। তাই একদম চিন্তা কোরো না।”
জেরোডাইন বলল, “চলো বাচ্চারা, এবার ঘুমোনোর সময়। আমরা খুব শিগগিরই আমাদের নতুন বাড়ি পৌঁছে যাব।”
ফিল্মটা নষ্ট করে ফেলার আগে জেরোড লেখাটা আরেকবার পড়ল। তাতে লেখা: এই উত্তর দেবার মত পর্যাপ্ত তথ্য আমার কাছে নেই।
সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভিডিওস্ক্রিনের দিকে তাকাল। এক্স-২৩ এখন ঠিক সামনে।
।। তিন ।।
ভিজে-২৩ এক্স এফ ল্যামেথ গ্যালাক্সির ত্রিমাত্রিক মানচিত্রের কালো গভীরতার দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, আমরা কি এই বিষয়টা নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছি?”
এমকিউ-১৭ জে এফ নাইক্রন মাথা নাড়ল। “আমার তা মনে হয় না। যে হারে এই বিস্তার চলছে, তাতে আগামী পাঁচ বছরেই এই গ্যালাক্সিটা ভরে যাবে।”
দুজনের বয়সই দেখে মনে হবে বিশ-বাইশের কোঠায়। দুজনেই দীর্ঘদেহী, নিখুঁত তাদের গড়ন।
“তবু…” ভিজে-২৩এক্স বলল, “গ্যালাক্টিক কাউন্সিলে এমন একটা হতাশাজনক রিপোর্ট জমা দিতে আমার কেমন যেন লাগছে।”
“আমি তো অন্য কোনো রিপোর্টের কথা ভাবতেই পারছি না। ওদের একটু নাড়া দেওয়া দরকার। একটা ধাক্কা খুব দরকার।”
ভিজে-২৩এক্স দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “মহাকাশ তো অসীম। আমাদের হাতের নাগালে এখনও দশ হাজার কোটি গ্যালাক্সি আছে।… হয়তো তারও বেশি।”
“দশ হাজার কোটি মানে কিন্তু অসীম নয়। আর সেই সংখ্যাটাও খুব দ্রুত কমছে। ভেবে দ্যাখো! কুড়ি হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম নক্ষত্রের শক্তি ব্যবহার করতে শেখে। তার কয়েকশো বছরের মধ্যেই আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণ সম্ভব হয়। একটা ছোট্ট গ্রহ ভরতি করতে মানুষের লেগেছিল দশ লক্ষ বছর, আর বাকি গ্যালাক্সিটা ভরতি করতে লাগল মোটে পনেরো হাজার বছর। আর এখন প্রতি দশ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে…”
ভিজে-২৩এক্স বাধা দিল। “এর জন্য আমরা অমরত্বকে ধন্যবাদ দিতে পারি।”
“তা ঠিক। অমরত্ব এখন বাস্তব, আর সেটা ধরেই আমাদের এগোতে হবে। মানতেই হবে, এই অমরত্বের কিছু কুফলও আছে। ‘গ্যালাক্টিক এসি’ আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করেছে, কিন্তু বার্ধক্য আর মৃত্যুকে জয় করার সমাধানটা করে ও যেন বাকি সব সমাধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।”
“তবু তুমি নিশ্চয়ই এই জীবনটা বিসর্জন দিতে চাইবে না।”
“একদমই না,” এমকিউ-১৭জে ঝাঁঝিয়ে উঠল, পরক্ষণেই সুর নরম করে বলল, ” অন্তত এখনই না। আমার অত বয়স হয়নি। তোমার কত হলো?”
“দুইশো তেইশ। আর তোমার?”
“আমি এখনও দুইশোর নিচেই আছি। …যাই হোক, আসল কথায় ফেরা যাক। প্রতি দশ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। এই গ্যালাক্সিটা ভরে গেলে, পরের দশ বছরে আমরা আরেকটা ভরতি করে ফেলব। তার পরের দশ বছরে আরও দুটো। তার পরের দশকে চারটে। একশো বছরের মধ্যে আমরা এক হাজার গ্যালাক্সি পূর্ন করে ফেলব। আর এক হাজার বছরে করব দশ লক্ষ। আর দশ হাজার বছরের মধ্যে এই জানা মহাবিশ্বের পুরোটাই ভরে যাবে। তারপর…তারপর কী?”
ভিজে-২৩এক্স বলল, “এর সাথে তো যাতায়াতের সমস্যাটাও আছে। এক গ্যালাক্সির মানুষগুলোকে অন্য গ্যালাক্সিতে সরাতে কত লক্ষ ‘সানপাওয়ার ইউনিট’ খরচ হবে, কে জানে!”
“ভালো কথা মনে করেছ। এখনই মানবজাতি বছরে দুটো করে ‘সানপাওয়ার ইউনিট’ খরচ করছে।”
“যার বেশিরভাগটাই অপচয় হচ্ছে। আমাদের এই একটা গ্যালাক্সিই তো বছরে হাজারটা ‘সানপাওয়ার ইউনিট’ বিকিরণ করছে। আমরা তার মাত্র দুটো ব্যবহার করি।”
“মানলাম। কিন্তু আমরা যদি একশো শতাংশ শক্তিও ব্যবহার করতে পারতাম, তাহলেও শেষ রক্ষা হতো না। আমাদের শক্তির চাহিদা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, জনসংখ্যার চেয়েও দ্রুত। গ্যালাক্সি ফুরোনোর আগেই আমাদের শক্তি ফুরোবে। খুব ভালো একটা কথা মনে করিয়েছ।”
“আমাদেরকে আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস দিয়ে নতুন তারা তৈরি করতে হবে।”
“নাকি এই ছড়িয়ে পড়া তাপ জড়ো করে?” এমকিউ-১৭জে ব্যঙ্গের সুরে বলল।
“কে জানে? হয়ত এনট্রপিকে উল্টে দেওয়ার কোনো উপায় আছে। আমাদের ‘গ্যালাক্টিক এসি’-কে জিজ্ঞেস করা উচিত।”
ভিজে-২৩এক্স কথাটা ঠিক গুরুত্ব দিয়ে বলেনি, কিন্তু এমকিউ-১৭জে তার পকেট থেকে ‘এসি-কন্ট্যাক্ট’ যন্ত্রটা বের করে টেবিলে রাখল।
“আমারও মনটা কেমন খচখচ করছে,” সে বলল। “আজ হোক বা কাল, মানবজাতিকে এই সত্যিটার মুখোমুখি হতেই হবে।”
সে তার ছোট্ট ‘এসি-কন্ট্যাক্ট’ যন্ত্রটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। মাত্র দু-ইঞ্চি একটা ঘনক। যন্ত্রটা নিজে কিছুই নয়, কিন্তু হাইপারস্পেসের মাধ্যমে সে যুক্ত আছে সেই মহান ‘গ্যালাক্টিক এসি’-র সাথে, যা সমগ্র মানবজাতির সেবা করে। হাইপারস্পেসের চিন্তা করলে, এটা যেন সেই ‘গ্যালাক্টিক এসি’-রই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এমকিউ-১৭জে ভাবছিল, তার এই অমর জীবনে সে কি কখনো সেই ‘গ্যালাক্টিক এসি’-কে চাক্ষুষ দেখতে পাবে? ‘গ্যালাক্টিক এসি’ থাকে তার নিজের ছোট্ট একটা জগতে। বল-তরঙ্গের এক সূক্ষ্ম জাল দিয়ে সে পদার্থকে ঘিরে রাখে, যার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে সাব-মেসনের স্রোত – সেই আদিমকালের আণবিক ভাল্ভের বদলে। এই অতিলৌকিক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও, ‘গ্যালাক্টিক এসি’ যে আকারে প্রায় এক হাজার ফুট চওড়া, তা সবার জানা ছিল।
এমকিউ-১৭জে হঠাৎ তার যন্ত্রটিকে জিজ্ঞেস করল, “এনট্রপিকে কি কখনো উল্টে দেওয়া সম্ভব?“
ভিজে-২৩এক্স চমকে উঠে বলল, “আরে, কি করছো! এখনই প্রশ্নটা করতে বলিনি।”
“কেন? ক্ষতি কী?”
“আমরা দুজনেই জানি এনট্রপিকে উল্টানো যায় না। তুমি তো ধোঁয়া আর ছাই থেকে একটা আস্ত গাছকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।”
“তোমার গ্রহে কি গাছ আছে?” এমকিউ-১৭জে জিজ্ঞেস করল।
‘গ্যালাক্টিক এসি’-র কণ্ঠস্বর তাদের আলোচনায় বাধা দিল। টেবিলের ওপর রাখা ছোট্ট যন্ত্রটা থেকে ভেসে এলো এক মিহি, সুন্দর স্বর। সে বলল: এই উত্তর দেবার মত পর্যাপ্ত তথ্য আমার কাছে নেই।
ভিজে-২৩এক্স বলল, ” দেখলে তো!”
এরপর তারা দুজনেই গ্যালাক্টিক কাউন্সিলকে কী রিপোর্ট দেওয়া হবে, সেই আলোচনায় আবার ফিরে গেল।
।। চার ।।
জি প্রাইমের মন এই নতুন গ্যালাক্সিটাকে দেখছিল। অগণিত তারার জট পাকানো জঙ্গলের মত দেখতে। সে এই গ্যালাক্সিটা আগে কখনো দেখেনি। সে কি কখনো সবকটা গ্যালাক্সি দেখে শেষ করতে পারবে? এত এত গ্যালাক্সি, আর প্রত্যেকটাই মানুষে ঠাসা।
যদিও মানুষ এখন এক মৃতপ্রায় বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের আসল সত্তা এখন ছড়িয়ে আছে এই মহাশূন্যে।
একটা চেতনা, শরীর নয়!
সেই অমর দেহগুলো পড়ে আছে গ্রহের বুকে, যুগ যুগ ধরে সুপ্ত অবস্থায়। কখনো সখনো তারা জাগে, পার্থিব কোনো কাজে অংশ নেয়, কিন্তু সে ঘটনাও খুব বিরল। এই অবিশ্বাস্য ভিড়ে যোগ দেওয়ার জন্য নতুন কোনো মানব সদস্যও আর আসছে না। তাতে কী-ই বা এসে যায়? নতুন সদস্যের জন্য এই মহাবিশ্বে জায়গাই বা কই?
জি প্রাইম তার ভাবনার জগত থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো অন্য একটি মনের সূক্ষ্ম অস্তিত্ব টের পেয়ে।
“আমি জি প্রাইম,” জি প্রাইম বলল। “আর তুমি?”
“আমি ডি সাব ওয়ান। তোমার গ্যালাক্সি?”
“আমরা একে শুধু ‘গ্যালাক্সি’ বলি। আর তোমরা?”
“আমরাও তাই বলি। সব মানুষই নিজের গ্যালাক্সিকে শুধু ‘গ্যালাক্সি’ বলেই ডাকে। ডাকবে না-ই বা কেন?”
“তা ঠিক। যেহেতু সব গ্যালাক্সিই একরকম।”
“সব গ্যালাক্সি একরকম নয়। কোনো একটা নির্দিষ্ট গ্যালাক্সিতেই তো মানব সভ্যতার শুরু হয়েছিল। সেটা তো আলাদা হবেই।”
জি প্রাইম বলল, “কোনটা সেটা?”
“আমি বলতে পারব না। ‘ইউনিভার্সাল এসি’ হয়তো জানবে।”
“চলো তাকে জিজ্ঞেস করি। আমার হঠাৎ খুব জানতে ইচ্ছে করছে।”
জি প্রাইমের চেতনা প্রসারিত হলো। এতগুলো গ্যালাক্সি তার কাছে যেন এক ঝাপসা ধুলোর আস্তরণ হয়ে গেল। লক্ষ কোটি গ্যালাক্সি, প্রত্যেকটিতে বাস করে অমর মানুষেরা, তাদের চেতনা সারা মহাবিশ্বে ভেসে বেড়াচ্ছে। তবুও, এদের মধ্যে একটি গ্যালাক্সি ছিল অনন্য – আদি গ্যালাক্সি। সুদূর, অস্পষ্ট অতীতে এমন একটা সময় ছিল যখন সেটাই ছিল মানুষের একমাত্র ঠিকানা।
জি প্রাইম সেই গ্যালাক্সিটাকে দেখার জন্য হটাৎ করে অদম্য কৌতূহল বোধ করল। সে বলল: “ইউনিভার্সাল এসি! কোন গ্যালাক্সিতে মানুষের উৎপত্তি হয়েছিল?”
‘ইউনিভার্সাল এসি’ সে ডাক শুনতে পেল। কারণ প্রতিটি জগতে, প্রতিটি শূন্যস্থানে তার যোগাযোগ যন্ত্র আছে, আর প্রতিটি গ্রাহকযন্ত্র হাইপারস্পেসের মাধ্যমে যুক্ত থাকে সেই অজানা বিন্দুর সাথে, যেখানে ‘ইউনিভার্সাল এসি’ নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে।
জি প্রাইম শুধু একজন মানুষের কথা জানত, যার ভাবনা ‘ইউনিভার্সাল এসি’-র কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছিল। সে ফিরে এসে বলেছিল, ইউনিভার্সাল এসি দেখতে মাত্র দু-ফুট ব্যাসের একটা উজ্জ্বল গোলক এর মত, যা ঠিকমতো দেখাও যায় না।
“কিন্তু ওইটুকুই ‘ইউনিভার্সাল এসি’ হয় কী করে?” জি প্রাইম জিজ্ঞেস করল।
“ওর বেশিরভাগটাই হাইপারস্পেসে,” উত্তর এল। “সেখানে ও কী রূপে আছে, তা আমার কল্পনারও অতীত।”
আসলে কেউই আর জানত না ‘ইউনিভার্সাল এসি’ দেখতে কেমন। যে সকল মানুষেরা এই কম্পিউটার বানিয়েছিল সুদূর অতীতে তারা হয়ত বলতে পারত। এখন প্রত্যেক ‘ইউনিভার্সাল এসি’ নিজেই তার উত্তরসূরিকে নকশা ও নির্মাণ করে। প্রতি দশ লক্ষ বা তারও বেশি সময় ধরে এই কম্পিউটার প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে, যাতে সে আরও ভালো, আরও জটিল, আরও সক্ষম এক যন্ত্র তৈরি করতে পারে। আর সেই নতুন এসির মধ্যেই সে তার নিজস্ব তথ্যভাণ্ডার আর ব্যক্তিত্ব বীজের মত বপন করে দেয়।
‘ইউনিভার্সাল এসি’ জি প্রাইমের ভাবনায় বাধা দিল। কোনো শব্দ দিয়ে নয়, পথ দেখিয়ে। জি প্রাইমের চেতনাকে সে নিয়ে গেল গ্যালাক্সিদের এক আবছা সমুদ্রের দিকে। এদের মধ্যে একটি বিশেষ গ্যালাক্সি বড় হতে হতে তারার গুচ্ছে পরিণত হলো।
একটা বার্তা এলো, সীমাহীন দূরত্ব থেকে, কিন্তু স্পষ্টভাবে: “এটাই মানুষের আদি গ্যালাক্সি।”
কিন্তু… এ তো অন্য যে কোনোটার মতোই দেখতে। জি প্রাইম তার হতাশা লুকোনোর চেষ্টা করল।
ডি সাব ওয়ান, যার চেতনাও তার সাথে ভ্রমণ করছিল, হঠাৎ বলে উঠল, “আর এই তারাগুলোর মধ্যে কোনো একটা কি মানুষের আদি তারা?”
‘ইউনিভার্সাল এসি’ বলল, “মানুষের আদি তারাটি নোভা হয়ে গেছে। ওটা এখন একটা শ্বেত বামন (White Dwarf)।”
“সেখানকার মানুষেরা কি মারা গিয়েছিল?” জি প্রাইম চমকে উঠে না ভেবেই জিজ্ঞেস করে ফেলল।
‘ইউনিভার্সাল এসি’ বলল, “এরকম ক্ষেত্রে যা হয়, ওদের জৈবিক দেহগুলোর জন্য সময়মতো একটি নতুন স্থান নির্মাণ করা হয়েছিল।”
“হ্যাঁ, তা তো বটেই,” জি প্রাইম বলল, কিন্তু তবুও একটা গভীর শূন্যতা তাকে গ্রাস করল। মানুষের আদি গ্যালাক্সির ওপর থেকে তার আগ্রহ হারিয়ে গেল। গ্যালাক্সিটা আবার সংকুচিত হয়ে সেই অস্পষ্ট বিন্দুর ভিড়ে হারিয়ে গেল। জি প্রাইম আর কখনো এটার কথা মনে করতে চায় না।
ডি সাব ওয়ান বলল, “কী হয়েছে তোমার?”
“তারাগুলো মরে যাচ্ছে। আমাদের আদি তারাটাও মরে গেছে।”
“সবাইকেই তো মরতে হবে। তাতে কী?”
“কিন্তু যখন সব শক্তি শেষ হয়ে যাবে, আমাদের এই দেহগুলোও তো মরে যাবে। আর তার সাথে তুমি, আমিও।”
“সে তো লক্ষ কোটি বছর পরের কথা।”
“লক্ষ কোটি বছর পরেও আমি তা হতে দিতে চাই না। ‘ইউনিভার্সাল এসি’ আমি জানতে চাই তারাগুলোকে মরে যাওয়ার থেকে বাঁচানো যায় কীভাবে?”
ডি সাব ওয়ান যেন মজা পেয়ে বলল, “তুমি তো আসলে জানতে চাইছ, এনট্রপিকে কীভাবে উল্টোদিকে নেয়া যায়!”
কিছুক্ষন নিরবতার পর – ‘ইউনিভার্সাল এসি’ উত্তর দিল: “এই উত্তর দেবার মত পর্যাপ্ত তথ্য আমার কাছে নেই।“
জি প্রাইমের চেতনা দ্রুত তার নিজের গ্যালাক্সিতে ফিরে এলো। ডি সাব ওয়ানের কথা সে আর ভাবল না। ডি সাব ওয়ানের দেহ হয়তো তার থেকে এক ট্রিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের কোনো গ্যালাক্সিতে অপেক্ষা করছে, অথবা হয়তো জি প্রাইমের পাশের তারাটাতেই। তাতে মহাবিশ্বের কিছু যায় আসে না।
একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে, জি প্রাইম আন্তঃনাক্ষত্রিক হাইড্রোজেন গ্যাস সংগ্রহ করতে শুরু করল। সে নিজের জন্য একটা ছোট্ট তারা বানাবে। যদি সব তারাকেই একদিন মরতে হয়, অন্তত কিছু নতুন তারা তো এখনও তৈরি করা যায়।
।। পাঁচ ।।
‘মানুষ’ নিজের সাথে নিজেই কথা বলছে। কারণ এক অর্থে, মানসিকভাবে, মহাবিশ্বের সকল ‘মানুষ’ এখন এক।
সে এখনও লক্ষ কোটি, কোটি, কোটি অবিনশ্বর দেহের সমষ্টি। প্রতিটি দেহ তার নির্দিষ্ট স্থানে শান্তির নিদ্রায় আছে। নিখুঁত এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্ররা তাদের দেখভাল করছে। আর সেই সব দেহের মনগুলো একে অপরের সাথে মিশে একটা মহাজগতিক চেতনা তৈরি করেছে, এখন আর তাদের আলাদা করে চেনার উপায় নেই।
‘মানুষ’ বলল, “মহাবিশ্ব মরে যাচ্ছে।”
‘মানুষ’ তার চারপাশে ম্রিয়মাণ গ্যালাক্সিগুলোর দিকে তাকাল। সেই দৈত্যাকার, অমিতব্যয়ী তারাগুলো কবেই নিভে গেছে, সুদূর, ঝাপসা অতীতের গর্ভে। এখনকার প্রায় সব তারাই শ্বেত বামন, নিভে যাওয়ার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
তারাদের মাঝখানের ধুলোবালি দিয়ে নতুন তারা গড়া হয়েছে – কিছু প্রাকৃতিক নিয়মে, কিছু বা ‘মানুষ’ নিজেই গড়েছে। সেগুলোও এখন ফুরিয়ে আসছে। শ্বেত বামনদের একটার সাথে আরেকটার সংঘর্ষ ঘটিয়ে, সেই বিপুল শক্তি থেকে নতুন তারা গড়া হয়তো সম্ভব, কিন্তু প্রতি হাজারটা শ্বেত বামন ধ্বংস করে মোটে একটা নতুন তারা মিলবে। আর সেটারও তো একদিন শেষ আছে।
‘মানুষ’ বলল, “কসমিক এসির নির্দেশমতো, খুব সাবধানে খরচ করলেও, এই মহাবিশ্বে যা কিছু শক্তি অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে আরও লক্ষ কোটি বছর চলবে।”
“কিন্তু তারপর…,” ‘মানুষ’ বলল, “একদিন না একদিন সব শেষ হবেই। যত সাবধানেই রাখি, যত দীর্ঘই করি সময়, শক্তি একবার খরচ হয়ে গেলে তা ফুরিয়ে যায়, তাকে আর ফেরানো যায় না। এনট্রপিকে বাড়তেই হবে, তার চরমে পৌঁছনো পর্যন্ত।”
‘মানুষ’ বলল, “এনট্রপিকে কি উল্টানো যায় না? চলো, ‘কসমিক এসি’-কে জিজ্ঞেস করা যাক।”
‘কসমিক এসি’ তাদের চারপাশেই ছিল, কিন্তু এই চেনা মহাকাশে নয়। তার বিন্দুমাত্র অংশও এই মহাবিশ্বে নেই। সে থাকে হাইপারস্পেসে। এমন কিছু দিয়ে সে তৈরি, যা বস্তুও নয়, শক্তিও নয়। তার আকার বা প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন করার মতো কোনো ভাষা বা ধারণা ‘মানুষ’-এর আর জানা নেই।
“কসমিক এসি,” ‘মানুষ’ বলল, “কীভাবে এনট্রপিকে উল্টানো সম্ভব?”
‘কসমিক এসি’ বলল, “এই উত্তর দেবার মত পর্যাপ্ত তথ্য আমার কাছে নেই।“
‘মানুষ’ বলল, “আরও তথ্য সংগ্রহ করো।”
‘কসমিক এসি’ বলল, “তোমার নির্দেশ পালন করা হবে। আমি গত দশ হাজার কোটি বছর ধরে তাই করে আসছি। আমার পূর্বসূরিদের এবং আমাকে এই প্রশ্ন বহুবার করা হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে যত তথ্য আছে, সবই অপর্যাপ্ত।”
“এমন সময় কি কখনো আসবে,” ‘মানুষ’ বলল, “যখন তুমি পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে? নাকি এই সমস্যার কোনো সমাধানই কোনো পরিস্থিতিতে সম্ভব নয়?”
‘কসমিক এসি’ বলল, “এমন কোনো সমস্যা নেই, যা সমাধানযোগ্য নয়।”
‘মানুষ’ বলল, “কবে তোমার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য থাকবে?”
‘কসমিক এসি’ বলল, “এই উত্তর দেবার মত পর্যাপ্ত তথ্য আমার কাছে নেই।“
“তুমি কি এর সমাধান খুঁজে যাবে?” ‘মানুষ’ জিজ্ঞেস করল।
‘কসমিক এসি’ বলল, “আমি খুঁজে যাব।”
‘মানুষ’ বলল, “আমরা অপেক্ষা করব।”
।। ছয় ।।
আরো অনেক সময় পর, গ্যালাক্সিগুলো মরে গেল, নিভে গেছে সব তারা। দশ ট্রিলিয়ন বছর পর মহাকাশ এখন ঘুটঘুটে কালো।
একে একে ‘মানুষের’ চেতনা এসির মাঝে বিলীন হয়ে যেতে লাগল। মানুষের প্রতিটি জৈবিক দেহ তার চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে এসির সাথে এক হয়ে অন্য এক উচ্চতায় চলে গেল।
‘মানুষ’-এর শেষ মনটি বিলীন হওয়ার আগে একবার থামল। সে মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখল, শেষ এক অন্ধকার তারার অবশেষ ছাড়া আর কিছুই নেই। আছে শুধু অবিশ্বাস্যরকম পাতলা ধূলিকণা, যা পরম শূন্য তাপমাত্রার দিকে এগিয়ে চলা শেষ তাপবিন্দুর ছোঁয়ায় ইতস্তত কাঁপছে।
‘মানুষ’ বলল, “এসি, এটাই কি শেষ? এই বিশৃঙ্খলাকে (Chaos) কি আর কখনো মহাবিশ্বে উল্টে দেওয়া যায় না? সেটা কি আর সম্ভব নয়?”
এসি বলল, “এই উত্তর দেবার মত পর্যাপ্ত তথ্য আমার কাছে নেই।“
‘মানুষ’-এর শেষ মনটিও বিলীন হয়ে গেল। শুধু এসি একাই রয়ে গেল – এমন এক জায়গায় যা ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না- হাইপারস্পেসে।
বস্তু আর শক্তি ফুরিয়ে গেছে। তার সাথে ফুরিয়ে গেছে স্থান আর কালের বিভেদ। এমনকি এসি-ও টিকে আছে শুধু সেই একটা শেষ প্রশ্নের জন্য, যার উত্তর সে কখনো দিতে পারেনি। সেই যে দশ ট্রিলিয়ন বছর আগে, এক আধা-মাতাল টেকনিশিয়ান প্রশ্নটা করেছিল এক কম্পিউটারকে – যে কম্পিউটার ছিল এসির কাছে, মানুষ আর তার সভ্যতার তুলনার চেয়েও অনেক, অনেক তুচ্ছ।
বাকি সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু এই শেষ প্রশ্নটার উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত এসি তার চেতনাকে মুক্তি দিতে পারবে না।
সমস্ত তথ্য সংগ্রহ শেষ। নতুন করে আর কিছুই সংগ্রহ করার নেই।
কিন্তু এখনও, সংগৃহীত সমস্ত তথ্যকে পুরোপুরি বিশ্লেষণ করা, তাদের মধ্যেকার সমস্ত সম্ভাব্য সম্পর্ক খুঁজে বের করা বাকি।
সেই কাজে কেটে গেল এক কালহীন ‘বিরতি’ (timeless interval)। কারন এখন সময়ের কোন অস্তিত্ব নেই।
এবং অবশেষে সময়হীন জগতে এসি জানতে পারল, কীভাবে এনট্রপির গতিপথ উল্টে দিতে হয়।
কিন্তু সেই অন্তিম প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য তখন আর কোনো ‘মানুষ’ বা তাদের চেতনা অবশিষ্ট ছিল না।
তাতে কোন সমস্যা নেই। উত্তরটা – কাজের মাধ্যমেই – সেই মানুষকেই না হয় আবার ফিরিয়ে আনবে।
আরও একটা কালহীন বিরতির পর এসি ভাবল, কীভাবে কাজটা সবচেয়ে ভালোভাবে করা যায়। খুব সাবধানে, এসি তার পরিকল্পনাটা সাজিয়ে নিল।
এসির চেতনা সেই সমগ্র সত্তাকে ধারণ করল, যা একসময় আদি ‘মহাবিশ্ব’ ছিল। এখন যেখানে শুধুই ‘বিশৃঙ্খলা’। ধাপে ধাপে, কাজটা করতে হবে।
এসি বলল, “আলোকিত হোক!” (LET THERE BE LIGHT!)
এবং নতুন আলোর সূচনা হলো।
অনুবাদকের কথাঃ আইজ্যাক আসিমভ আমার প্রিয় সায়েন্স ফিকশন লেখকদের একজন। তার গল্পের বাংলা অনুবাদ করাটা বেশ কঠিন। কিছু কিছু যায়গায় মনে হয়েছে আক্ষরিক অনুবাদ করছি। কারন তিনি যে রহস্যময়তা নিয়ে লিখেছেন সেটা বোঝানো কিছুটা দুঃসাধ্য। “The Last Question” – আসিমভের মতে তার লেখা সেরা ছোট গল্পগুলোর একটা। কারন একদম শেষে গিয়ে তিনি জেনেসিস এর ঈশ্বরের মত করে বলেছেন, আলোকিত হোক।
— দেলোয়ার জাহান
