পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে মহাশুন্যে বিচরন করাটা মানবজাতির জন্য একটা বড় স্বপ্ন ছিল একসময়। সেই স্বপ্ন পুরন হয়েছে বিগত শতকেই। আমরা চাঁদে পা রেখেছি, মঙ্গলের প্রস্তুতি চলছে। আমাদের পৃথিবীর জটিল ধরনের হিসাব নিকেশ বের করার জন্য মহাশুন্যে প্রেরন করেছি ছোট বড় নানা আকারের স্যাটেলাইট। কোনটা প্রতিরক্ষার কাজ করে, তো কোনটা আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়। কিছু স্যাটেলাইট ইন্টারনেট আর রেডিও লিংকের কাজ করে। বিনোদন মিডিয়ার অনেকেরই নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে মহাকাশে।
মানুষের তৈরি বিশিরভাগ স্যাটেলাইটই লো-আর্থ অরবিটাল / Low Earth Orbit (LEO)। এসব স্যাটেলাইট ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৬০-২০০০ কি.মি. এর মধ্যে অবস্থান করে। এই সীমার মধ্যেই এরা পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে বেড়ায় বা পৃথিবীর ঘুর্ননের সাথে তাল রেখে ঘোরে (Geo Stationary) । আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনও (ISS) ও পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
এই লো-আর্থ অরবিটে নানা সাইজের এবং ওজনের স্যটেলাইট মানুষ প্রতিনিয়ত পাঠাচ্ছে। একেকটার কাজ একেক রকম। এদের একটা আয়ুষ্কালও আছে। মানে ঠিক কতদিন পরে এরা আর কোন কাজে লাগবে না। সমস্যা শুরু হবে এখান থেকেই। এদের কার্যক্ষমতা শেষ হয়ে যাবার পরে এরা মূলত স্পেস জাঙ্কে পরিনত হবে। কোন কাজ নেই অথচ কক্ষপথ দখল করে ঘুরে বেড়াবে। ধাক্কা লাগাতে পারে অন্য অকার্যকর বা সক্ষম স্যাটেলাইটের সাথেও। এই সকল স্যাটেলাইট জাঙ্ক আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা অনেক ব্যায়বহুল এবং বিপদজনকও বটে।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা এসব স্যাটেলাইটের উপর নানান ভাবে নির্ভরশীল ৷ জি,পি,এস থেকে শুরু করে আপনার বাসার টিভি প্রোগ্রামের রিলে সব কিছুই এই স্যাটেলাইট নির্ভর। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন অকার্যকর হয়ে যাওয়া এই সকল স্যাটেলাইট, যা স্পেস জাঙ্কে পরিনত হয়েছে এরা কি ভীষন গতিবেগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? এদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
Donald J. Kessler ১৯৭৮ সালে প্রথম এই ব্যাপারটার কথা বলেন। তার নামেই এই ঘটনার নাম দেওয়া হয় “কেসলার সিনড্রোম” (Kessler Syndrome)। তিনি বলেন কক্ষপথে রয়ে যাওয়া এই সকল বস্তু যখন একটা আরেকটার সাথে ধাক্কা খাবে তখন একটা চেইন বিস্ফোরনের সৃষ্টি হবে। এর ফলে ছোট ছোট টুকরোর সংখ্যা আরো বাড়বে এবং একে অপরের সাথে ধাক্কা খাবার পরিমানও ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাবে। কক্ষপথের এই সকল আবর্জনা যদি ১০ কি.মি./সে. বেগে থাকে এবং এই বেগে ১০ সে.মি. ব্যাসের একটি ছোট টুকরোর মধ্যে ৭ কি.গ্রা. টি.এন.টি. – এর সমান বিস্ফোরন ক্ষমতা থাকে। একবার কল্পনা করেন, এমন হাজারটা স্যাটেলাইট অনেক গতি নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে আর একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।
ফলাফল, আমাদের মহাকাশযান মিশনগুলো নির্বিঘ্নে এই লো-আর্থ অরবিট পার হতে পারবে না। সমস্যা হবে নতুন স্যাটেলাইট স্থাপনেও। বাড়বে কারিগরি ত্রুটি এবং মহাকাশচারীর মৃত্যুঝুঁকি।
২০০৯ সালে আমেরিকা ও রাশিয়ার কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট একে অপরের সাথে সংঘর্ষ ঘটায় এবং এতে প্রায় ২০০০ এর মত ছোট বড় স্পেস জাংকের সৃষ্টি হয়েছে।
আমরা এখন স্যাটেলাইট নির্ভর একটা প্রজাতি। আমাদের বিনোদন, কৃষি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, দিক নির্নয়, সামরিক, ভূ-জরিপ সব কিছু্র তথ্যই আসে স্যাটেলাইট থেকে। কেসলার যদিও বলেছেন স্পেস জাঙ্কের এই রকম অসহনীয় অবস্থায় পৌছতে আরো ৫০ বছরের মধ্যে লাগতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মনে এখনই চিন্তা চলে এসেছে কিভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে।
কেসলারের নিজের মুখ থেকেই শুনুন কি হতে পারে সে সম্পর্কেঃ
মানুষের স্যাটেলাইট প্রেরণের হার যে ভাবে বাড়ছে, এতে করে সবগুলো স্যাটেলাইটের গতিপথ হিসাব রাখে স্যাটেলাইট পাঠানো ও তার নিয়ন্ত্রণ ভবিষ্যতে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে । তাই গবেষণা চলছে কিভাবে এই আবর্জনাগুলো কক্ষপথ থেকে সরানো যাবে। থিওরোটিক্যালি এর একটা হল, পৃথিবী থেকে লেজার রশ্মি দিয়ে কৃত্রিম উপগ্রহের ভাঙা টুকরোগুলোকে কক্ষচ্যুত করে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ফিরিয়ে আনা। বায়ুমন্ডলের সাথে সংঘর্ষে সেই টুকরো জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
এছাড়া আজকাল কৃত্রিম উপগ্রহ বানানোর সময় এ বিষয়টি মাথায় রেখে এমন ভাবে বানানো হয়, যেন আয়ু ফুরোলে তারা নিজের কক্ষপথ পালটে অন্য একটা কক্ষপথে ঠাঁই নেয়। এই কক্ষপথের নাম হল Graveyard Orbit । অথবা, তারা যেন কাজ শেষে পৃথিবীতে নেমে আসে সেরকম করে তৈরি করা হয়।
একটা তথ্য জেনে অবাক হবেন, যতবারই স্পেস মিশন চালানো হয় এটা মাথায় রেখে মহাকাশযানগুলোর নকশা করা হয় যেন তারা বড়সড় আবর্জনা, পাথর ইথ্যাদি এড়িয়ে যেতে পারে, এবং অবশ্যই ছোটখাট সংঘর্ষ সহ্য করতে পারে।
মো. সাজেদুল হক। ছদ্মনাম, “হৃদয় হক”। বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। প্রধানত জ্যোতির্বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখালিখি তার পছন্দের।
লেখাটি অনেক ভালো হয়েছে। সত্যিই চিন্তার বিষয়। এমন আরও লেখা চাই তোমার কাছ থেকে। ভালো থেকো।