কেবল হাঁটতে শিখেছি, বাবা চলে গেলেন পরপারের উদ্দেশ্যে আমাকে এতিম বানিয়ে। শত কষ্ট জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করে মা আমাকে মানুষ করার চেষ্টা করেন,আমি একটু একটু করে বড় হই আর বুঝি। বুদ্ধি হলো … একটা ঈদ এলো, পাঁচ টাকা দিয়ে একটা প্যান্ট আর সাত টাকা দিয়ে একটা লাল শার্ট কিনে দিলো মা।
আমি যে কি খুশি হলাম, ধৈ ধৈ করে পাড়ায় বন্ধুদের দেখালাম। কিন্তু ঈদের দিন দেখলাম আমার শার্ট প্যান্টের চেয়ে বন্ধুদের জামা কাপড় জুতা সবই ভাল ভাল। ঈদের দিন আমি নতুন কাপড় পড়ে মাঠে চলে গেলাম আনন্দ করতে নামাজ পড়তে, বাড়ি এসে খেয়াল হলো মা কি কিনেছে তা দেখা হয়নি! দেখলাম মায়ের পরনে ছেঁড়া কাপড়, জামাটাও সেলাই করা, মন খারাপ হয়ে গেলো। বুঝলাম মায়ের কাছে টাকা পয়সা নেই তাই কোনো কিছু কিনতে পারে নাই।
চুপচাপ ছনের ঘরের পড়ার টেবিলের এক কোনে বসে রইলাম।
মা রান্না শেষে ডাকছে “আয় রে বাবা খেয়ে যা কত কাম পড়ে আছে”।
আমার আর খেতে ইচ্ছে করলো না। মা আবার ডাকলে আর থাকতে পারলাম না, খেতে বসে মা কে বললাম “মা তোমার যে ছেঁড়া কাপড়… জামা কিনলে না যে?
মা দুঃখের হাসি দিয়ে বলল, বাবারে এই তো পরে আছি, এখনো ভালো আছে কিন্তু; কিচ্ছু হবে না। তুমি বড় হয়ে নতুন জামা কাপড় দিলেই আমি পরতে পারবো!
চোখের পানি ভাতের থালায় পড়লো…মা দেখলো, আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল, বাবা অনেক বড় হও। বাবা রে আজ তোর বাবা থাকলে এত সব তো সেই করতো!
বাবা না থাকার তফাতটা সেদিন বুঝেছি… আরেকটু বড় হলাম তখন। মা কে যখন কঠিন বা কঠোর কাজ করে খাবার জামা কাপড় জোগাড় করতে দেখি তখন বাবার কথা মনে হয়! কত জমি জমা আছে মানুষের, তাদের বাবা রেখে গেছে, আমার বাবা পারেনি তাই বাবার কথা ভাবি।
বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো বা ঈদের দিনগুলো আরো সুন্দর, সুখের আর আনন্দের হতো। মায়ের কথা মত চলি, আল্লাহ চালিয়ে নেয় । পাশাপাশি পড়ালেখা করি। আমি একটু একটু করে বড় হই।
আবার যখন ঈদ এলো, আমি টুকটাক কাজ করে কিছু টাকা জমাই। তা দিয়ে আগে চুপিচুপি মায়ের জন্য একটা শাড়ি কাপড় কিনে এনে দেই। মা যে কত খুশি হয় … কি করে বুঝাই। মা বলে এই তো আমার বাবা বড় হয়ে গেছে। নিজেকে আসলেই অনেক বড় লাগে।
মা বাবার কথা মনে করে প্রায়ই কাঁদে, চুপিচুপি কাঁদে। আমারও তা দেখে কান্না পায়। মাষ্টার স্যার একদিন আসলেন, দেখেন মা কাঁদছে। তখন মা কে বুঝিয়ে বললেন, যে চলে গেছে তার জন্য কেঁদে কি আর হবে? নামাজ রোজা করে দোয়া করো আল্লাহ যেনো তাকে বেহেশত নসীব করেন। আর কেঁদো না, ছেলেটা বড় হচ্ছে না?
মা তখন আমার দিকে তাঁকায়। আমি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। আমি একটু একটু করে বড় হই, মাথার উপর বটবৃক্ষ নাই, ছায়া নাই। তাও আমি বড় হই।
মজনু মিয়া, মির্জাপুর টাংগাইল