কেন মানুষ কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস করে?


কন্সপিরেসি থিওরি হলো কোনো ঘটনাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে তার সাথে উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা মিশিয়ে তাকে রহস্যময় করে তোলা কনসেপ্ট। এটা সমাজের একদল লোককে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে এবং বেশিরভাগ সময়ই এটা সমাজে পাকাপোক্তভাবে গেঁড়ে বসে যায় ৷

এই রকম গুজব সাধারণত জনপ্রিয় কোনো ব্যক্তি, প্রভাবশালী অভিনেতা বা রাজনৈতিক ব্যক্তির দ্বারা চালু হয়ে ধীরে ধীরে পুরো সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। প্রাচীনকাল থেকেই এসব গুজবের বিশ্বাস চালু ছিল, কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না থাকার কারণে একটি নিদিষ্ট গোত্রের মধ্যেই সেটা সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু বর্তমানের তথ্য প্রযুক্তির যুগে সামান্য বিষয়ই বিশাল আকার ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কারণে।

সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু কন্সপিরেসি থিওরির মধ্যে একটি হলো চন্দ্র অভিযান ভূয়া। আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ে জিততে অভিযান শুটিং করেছে।

এছাড়া আছে, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে না, এরিয়া-৫১ এ এলিয়েন আছে,পৃথিবী সমতল সহ বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যু।
বিভিন্ন জঙ্গি হামলার বিষয়েও এধরণের তত্ত্ব প্রচলিত আছে। মজার ব্যাপার হলো সঠিক ব্যাখ্যা থাকার পরও কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাসীরা তা মানতে প্রস্তুত নয়। এখন আসি তারা এসবে বিশ্বাস কেন করে সে প্রসঙ্গে?

0 0 1 1 0 0 1 0 0 1 0 0 1 1

ভালো করে খেয়াল করুন এই নাম্বারগুলোর মধ্যে কোনো প্যাটার্ন খুঁজে পাচ্ছেন কি? যদি পেয়ে থাকেন তাহলে আপনি একা নন। প্রফেসর মার্ক লর্চের টুইটার পোলে ৫৬ শতাংশ লোক বলেছে তারা প্যাটার্ন খুজে পেয়েছ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো প্রফেসর সিকোয়েন্সটা শুধু কয়েন টস করে সেটার ফলাফলকে বাইনারি নাম্বার দ্বারা প্রকাশ করেছেন আর সেখানে প্যাটার্ন থাকার কোনো প্রশ্নই উঠে না। তারপরও আপনি সম্ভবত প্যাটর্ন খুঁজে পেয়েছেন।

কেন?

Illusionary Pattern Perception

এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে তারমধ্যে একটি ইলিউশনারি প্যাটার্ন পার্সেপশন  মানে যেকোনো র‍্যান্ডম (Random) জিনিসপত্রে আমাদের প্যাটার্ন বের করার স্বয়ংক্রিয় প্রবণতা।

বিশ্ব এক অনিশ্চিত জগৎ, এখানে টিকে থাকার স্বার্থেই আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত প্যাটার্ন খুঁজে সেগুলো অর্থবোধক করে তুলতে চায়। বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, প্রাচীনকালে যখন শিকার করে মানুষ জীবনযাপন করত তখন আমাদের পূর্বপুরুষদের এই প্রবণতা অনেক সাহায্য করেছে। কেউ একবার দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই এই ধরণের বাজে খাবার না খাওয়া, আকাশে কালো মেঘ জমেছে তার মানে ঝড় হবে, অমুক গাছের পাতা বিপদজনক তাই সেগুলো ব্যবহার না করা, কালো ছায়া মানে কোনো প্রাণী আক্রমণ করতে এসেছে। এসব কারণেই একটু সন্দেহপ্রবণ মানুষ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে গিয়েছে।

বিবর্তনের কারণে ব্রেইনের সেরেব্রাল কর্টেক্স (Cerebral Cortex) বিশেষ করে Frontal Cortex, Occipital Lobe, Temporal Lobe বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের প্যাটার্ন ডিটেকশন ক্ষমতাও প্রবল হয়ে উঠেছে। তাই অনেকসময় প্রকৃতপক্ষে যেখানে কোনো প্যাটার্ন নেই সেখানেও প্যাটার্ন খুঁজে পায়।

২০১৭ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব সোশ্যাল সাইকোলজিতে প্রকাশিত আর্টিকেলে বলা হয়, গবেষকরা ২০০-৪০০ জন লোকের মধ্যে ৫ টি পরীক্ষা পরিচালনা করেন। সেখানে দেখা যায়, যারা র‍্যান্ডম টসের মধ্যেও প্যাটার্ন খুজে পেয়েছে বা বিশৃঙ্খল পেইন্টিং এর মধ্যে প্যাটার্ন দেখতে পেরেছে তারাই অযৌক্তিক কোনো কিছুতে বিশ্বাস করে বেশি।

মনে করুন, তিনবার কয়েন টস করা হলো এবং তিনবারই টেইল পাওয়া গেল। এখন যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয় এরপর কি আসবে? তাহলে উত্তর দিবেন হেড বা টেইল যেকোনোটাই আসতে পারে, চ্যান্স ফিফটি ফিফটি কিন্তু যে কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস করে বলবে, যেহেতু তিনবার টেইল এসেছে তাই এইবার অবশ্যই হেড আসবে। 

Agency Detection

এটা কোনো কিছুর কাজের পেছনে মোটিভ বের করার প্রবণতা। এটাকে Theory of Mind (ToM) দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ToM হলো অন্যদের বিশ্বাস, ধারণা, মোটিভ, ভাবনাচিন্তা অর্থাৎ মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করতে পারার ক্ষমতা যেটা প্রত্যেকরই কিছু না কিছু পরিমানে থাকে।

মনে করুন আপনার এক বন্ধু আছে যে সবসময় প্রচুর লেট করে। যদি কোনোদিন কোথাও মিনিট পাঁচেক আগে উপস্থিত হয় তাহলে আপনি অনুমান করতে পারবেন যে ও মনে মনে ভাবছে যে আপনাকে ভালোই চমকে দিয়েছে, আবার আপনার বন্ধু আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারবে যে আপনি ভাবছেন সে ভালোই করেছে আগে এসে। এখন আপনারা ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে অন্য কথা শুরু করতে পারেন। এখানে কোনো ধরনের কথা না বলেই একে অন্যের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেছেন।

এটা আমাদের সমাজে সকলের সাথে ইন্টার অ্যাকশনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আমরা বুঝতে পারি কে আমাদের বন্ধু কে আমাদের শত্রু, কে আমাদের পছন্দ করে, কে করে না ইত্যাদি।

সাধারণত ৩-৪ বছর বয়স থেকেই এটার ডেভেলপমেন্ট হতে পারে। অটিজমসহ আরও কিছু নিউরোলজিকাল ডিজিজের কারণে যদি এটার ডেভেলপমেন্টে ঠিকমতো না হয় তাহলে দেখা যায় তারা সামাজিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না এবং সমাজে চলতে বা মিশতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয় ৷

কিন্তু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে Agency Detection এর ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে তারা সবকিছুতেই চক্রান্ত দেখতে পায়। মনে করে এলিয়েন পৃথিবীতে এসেছে কিন্তু সরকার আমাদের থেকে লুকাতে চাচ্ছে, অমুকে সিক্রেট পরিকল্পনা করছে ইত্যাদি।

Adaptive Conspiracism Hypothesis

এছাড়া জীববিজ্ঞানীরা একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা হলো, অ্যাডাপটিভ কন্সপিরাসিজম হাইপোথিসিস (Adaptive Conspiracism Hypothesis) । এটা অনেকটা একরম – ধরা যাক আপনি রাস্তায় হাঁটছেন, এমন সময় দেখতে পেলেন একটা সাপ, আপনি ভয় পেয়ে সরে দাঁড়ালেন। পরে খেয়াল করে দেখলেন, আরে এটা তো দড়ি। এটা হাস্যকর তারপরও কোনো ক্ষতি হয়নি আপনার। আবার হাঁটতে থাকলেন দেখতে পেলেন, একটা দড়ি। নির্দ্বিধায় হাঁটা চালিয়ে গেলেন কিন্তু এবার দড়ি নয়, সত্যিকার অর্থেই সাপ ছিল যেটা আপনার জীবন সংশয়ের কারণ হিসেবে দাঁড়াবে। এখানে আমরা দুইধরনের error দেখতে পাচ্ছি-

Type-I Error (False Positive) : প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যেখানে সত্যিকার অর্থে কোনো প্যাটার্ন নেই। (Low Cost)

Type -II Error (False Negative) : প্যাটার্ন থাকার পরও না খুঁজে পাওয়া। (High Cost)

প্রথম ধরনের ভুল করলে খুব বেশি আসে যায় না কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের ভুল করলে আপনাকে জীবন-মরণের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ শত্রু না থাকার পরও প্রস্তুতি নেওয়া, শত্রু থেকেও অপ্রস্তুত থাকা চেয়ে ভালো।

এজন্য ব্রেইনের ডিফল্ট পজিশন হলো বিশ্বাস করে নেওয়া সব প্যাটার্নই সত্যি। 

এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো ডোপামিন লেভেল। ডোপামিন এক ধরনের হরমোন এবং নিউরোট্রান্সমিটার যেটা ইমোশন এবং কগনিশন এর সাথে যুক্ত। ডোপামিন লেভেল একটা নিদিষ্ট মাত্রার কমবেশি হলে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা যায়। যদি কম থাকে তাহলে পারকিনসন ডিজিজ এর মতো সমস্যা দেখা যায় আবার বেশি হলে হ্যালুসিনেশন, প্যারানয়া, ডিল্যুশন ইত্যাদি সাইকোলজিক্যাল সমস্যা হয়। 

যারা জেনেটিক্যাল কারণে একটু বেশি ডোপামিন নিঃসরণ করে, তারা কন্সপিরেসি থিওরিতে বেশি বিশ্বাস করে। পিটার ব্রুগার (Peter Brugger) তার সহকর্মী  ক্রিস্টিন মোর (Christine Mohr) ৪০ জন সাবজেক্ট এর উপর L-Dopa প্রয়োগ করে ডোপামিন নিঃসরণ বৃদ্ধি করে দেখেছেন যারা স্বাভাবিক অবস্থায় প্যাটার্ন খুঁজে পায়নি
তারাও র‍্যান্ডম জিনিসে প্যাটার্ন খুঁজে পাচ্ছে।

আবার নিউরোলেপটিকস ড্রাগ (Neuroleptics Drug) যেটা হ্যালুসিনেশন, ডিল্যুশন, প্যারানয়াসহ বিভিন্ন psychotic behavior এর চিকিৎসা ব্যবহার করা হয়। এটা ডোপামিন রিসেপ্টর ব্লক করে দেয়। তো এই ড্রাগ প্রয়োগ করার পর দেখা গেলো যারা র‍্যান্ডম জিনিসে প্যাটার্ন খুঁজে পেত তারাও কোনে প্যাটার্ন খুঁজে পাচ্ছে না।

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণাগুলোর মাধ্যমে জানা যায়, যারা এই ধরণের তত্ত্বে বিশ্বাস করে তাদের মধ্যে কোনো কিছুর মধ্যে ব্যাখ্যা না পেলে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দেবার প্রবণতা, কম বিশ্লেষণী ক্ষমতা, হতাশা, ক্ষমতাহীনতা, একাকিত্ব ইত্যাদি সমস্যা থাকে। আর স্বল্প শিক্ষিত হওয়াও একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

তাছাড়া এমনিতেই বাস্তবতার চেয়ে গালগল্প অনেক মুখরোচক তাই কোনো একটা ঘটনার সত্যতার থেকে সেটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাড়িয়ে বলা বিভিন্ন কথা বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

থ্রিলার উপন্যাসের মতো মনে কনসেপ্ট তো ভালো লাগবেই তাই এর অসাড়তা প্রমাণ হবার পরও মানুষ সেটা মানতে চায় না।

বর্তমানে ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে যেকোনো ধরণের সংবাদ অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে থাকে। সঠিক জ্ঞানের অভাবে অনেকে সব কিছুতেই বিশ্বাস করছে তাই কন্সপিরেসি থিওরি আরও বেড়েই চলেছে। এর মাঝেও আশার বিষয় হলো সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে এর সাথে মোকাবিলা করা সম্ভব । গবেষণায় এটা উঠে এসেছে যে উচ্চ শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রবণতা কম।

নর্থ ক্যারোলিনা স্টেইট ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির প্রফেসর Anne Mclaughlin বলেছেন, “ক্রিটিক্যাল থিংকিং এমন একটা জিনিস যেটা শেখানো যেতে পারে এবং যদি মানুষকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাহলে লজিক এবং রিজনিং এর মাধ্যমে কন্সপিরেসি থিওরি এবং স্যুডো সায়েন্স এর মোকাবিলা করা সম্ভব। ব্রেইন ফলস কানেকশন তৈরি করার চেষ্টা করবে তারমানে এটা নয় যে আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে ।


রেফারেন্সঃ

মতামত দিনঃ