এই লেখায় জুনের শেষ ও জুলাই মাসের প্রথম দিকের রাতের আকাশ বর্ননা করা হয়েছে মূলত।
তারিখঃ ২৮/০৬/২০২০
সময়: রাত প্রায় ৮টা ১৫মি. হতে প্রায় ৮টা ৪০ মি.।
স্থান: খতিবেরহাট, বহদ্দারহাট, পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম।
দুপুর থেকেই বিদ্যুৎ নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। তবুও বিদ্যুতের দেখা নেই। পড়ার টেবিলের পাশেই জানালা। সন্ধ্যের পর সাধারণত বন্ধ থাকে, মশার জন্যে। তবে আজ বিদ্যুৎ নেই, গরমে শরীর হতে যেন ঘামের বন্যা বইছে। মশার কয়েল জ্বালিয়ে কিচ্ছুক্ষণ বাদে জানালা খুললাম। আহ, কি ফুরফুরে বাতাস। জানালার ওপাশে নারিকেল গাছ, মাথা হেলিয়ে গাছের পাতার ফাঁকে দেখি দু-তিনটা তারা, অন্যদিকে চাঁদ। বিদ্যুৎ নেই, আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার, অর্ধ চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে। রাত আনুমানিক আটটা বেজে পনেরো মিনিট, ঘর ছেড়ে ছাদে যাচ্ছি।
ছাদের দরজা খুলতেই প্রথমে চোখ যায় সে সময়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, বৃহস্পতি গ্রহে। দক্ষিণ-পূর্ব হতে তুলনামূলক বেশ পূর্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তার পিছনেই শনি। তারপর চোখ যায় সোজা দক্ষিণে। সেখানে পাশাপাশি দুটি তারা দুচোখে ধরা দেয়। বাম পাশেরটার নাম “জয়” (Rigil Kent) ডানেরটা “বিজয়” (Hadar), এ দুয়ের উপরে তুলনামূলক হালকা ডান দিকের তারাগুলো নিয়ে নিয়ে গঠিত “সেন্টরাস মণ্ডল”, হিন্দু জ্যোতিষে “মহিষাসুর”। “জয়” হল সমগ্র আকাশ পটের তৃতীয় উজ্জ্বল তারা। এর নিচে একটু বামেই প্রকসিমা সেন্টরির অবস্থান। প্রকসিমা মানেই নিকটতম, এটি আমাদের সূর্যের পর সবচেয়ে নিকটবর্তী তারা। তবে খালি চোখে একে দেখা অসম্ভব। জয়ের উপরে এবং তুলনামূলক বামের তারাগুলো নিয়ে হল “শার্দূল মণ্ডল”, ইংরেজিতে “লুপাস”। লুপাস হলো নেকড়ে, সেন্টরাস হল অর্ধ মানব – অর্ধ ঘোড়া। ঘোড়ার শরীরের উপর মানুষকে মাথা। সে যেন তার হাতে থাকা বল্লম দিয়ে নেকড়েটাকে বিদ্ধ করে আছে। যেন বলি দিচ্ছে, আরার¹ কাছে।
এরপর চোখ গেল বিশাল এক বিছার নিকট, বৃশ্চিক রাশি²। লুপাসের উপরে বামদিকে পরপর তিনটে তারা, প্রায় একই সরলরেখায়, আবার এই তিন তারার পেছনেই একটা লাল রঙের তারা, এর নিচে আরেকটি তারাসহ কিছু তারা নিয়ে একটা গোটানো লেজ কল্পনা করা যায়। আসলে এটা লেজ না, হুল, বিছার হুল। এ মণ্ডল এতোই সুন্দর এবং স্পষ্ট যে আপনাকে বিশেষ ভাবে চিনিয়ে দিতে হবে না, দেখলেই বুঝতে পারবেন। লাল তারাটি রাতের আকাশে উজ্জ্বলতার দিক থেকে সপ্তম। ইংরেজিতে এর নাম “Antares” বাংলায় জ্যেষ্ঠা বা পারিজাত। বাংলার জ্যৈষ্ঠ মাসের নাম রাখা হয়েছে এই জ্যেষ্ঠা তারা থেকে।
উক্ত তিন তারার ডানে কিছু তারা দিয়ে একটা সামান্তরিক কল্পনা করা যায়, তা দিয়েই তৈরি তুলা রাশি। সামান্তরিকের নিচের রেখার শেষ বিন্দু একটা লাল তারা অন্যদিকের শেষ বিন্দু একটা নীল তারা, ইংরেজিতে এর নাম “Zubenelgenubi“, বাংলায় বিশাখা, এ তারার অনুসারে বাংলা সালের প্রথম মাসের নাম বৈশাখ।
আবার উক্ত তিন তারার বামে উপরে বেশ দূরত্বের কিছু তারা দিয়ে একটা ষড়ভুজ কল্পনা করা যেতে পারে, এর নাম “Ophiuchus”, বাংলায় স্বর্পধারী। তার বাম পাশেই রয়েছে স্বর্প মণ্ডল (Serpens), সেখানে খুবই কাছাকাছি ৩টি তারা দিয়ে ত্রিভুজ ভাবা যায়, এটা সাপের মাথা, পিছের তারা দিয়ে সাপের লেজ। তুলা রাশির উপরে এটি অবস্থিত।
পূর্বে তাকালে আগেপিছে দুটো তারা দেখা যায়। সামনেরটার উজ্জ্বলতা কম, পিছেরটার বেশি। পিছেরটার ডানপাশে একটা মোটামুটি উজ্জ্বলতার তারা, আরো একটু ডানে আরো অনুজ্জ্বল একটি। এই মোটামুটি সরলরেখার বেশ উপরে ও বেশ নিচে দুপাশে দুটি তারা। এই দুটি তারা দুটি ডানা নির্দেশ করে, ঈগল পাখির ডানা। এ তারাগুলো দিয়ে একটা ঈগল কল্পনা করে হয়, এটা “Aquia” বা ঈগল মণ্ডল।
উত্তর-পূর্বে তাকালাম, সেদিকের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি হল অভিজিৎ (Vega), আমাদের পরবর্তী ধ্রুব তারা³। এই তারার পাশেই চারটি তারা দিয়ে বেশ ছোট একটা সামান্তরিক কল্পনা করা যায়, এসব নিয়েই তৈরি Lyra বা বীণা মণ্ডল। সনাতন ধর্মের প্রায় সকলেরই দেবোর্ষি নারদকে জানার কথা। কোনো কোনো বর্ণনা মতে তিনিই বীণা যন্ত্রের উদ্ভাবক। তার প্রিয় এই বীণাটিই যেন রাতের আকাশে আমরা দেখি।
অভিজিতের নিচে, উত্তর-পূর্বে পাশাপাশি ভালোই উজ্জল দুটো তারা দেখা যায়। দুটোর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলটার নাম “পুচ্ছ”(Deneb), এই দুই তারা থেকে একটা সরলরেখা টেনে কিছুদূর এগিয়ে গেলে এবং দ্বিতীয় তারাটির দু’দিকে কিছু তারা দিয়ে দুটি পাখা কল্পনা করলে একটা বড় বক পাখির দেখা মেলে। এটি আমাদের Cygnus বা বক মণ্ডল।
বক মণ্ডলের বেশ পূর্বে এবং ঈগল মণ্ডলের হালকা বামে এবং উভয় মণ্ডলের বেশ নিচে অনেকটা তারাগুচ্ছের মতো কিছু তারা দেখা যায়। সব তারা প্রায় একই উজ্জ্বলতার, তবে কিছুটা অনুজ্জ্বল। মোটামুটি চার-পাঁচটি তারা। এ নিয়ে গঠিত হয় ডলফিন মণ্ডল। আসলে একে বাংলায় শ্রবিষ্ঠা বলে, তবে আমি ডলফিন বলবো, ইংরেজিতে ডেলফিনাস। দেখতে অনেকটা আমাদের দুইটার ম্যাচবক্সের ডলফিনটার মতো। শহর থেকে একে দেখা বেশ কষ্টের, ভাগ্যিস বিদ্যুৎ ছিলো না!
অভিজিতের উপরে, মোটামুটি মাথায় উপরে চারটা তারা দিয়ে একটা সামান্তরিক কল্পনা করলে ও আশেপাশের কিছু তারা দিয়ে গঠিত মহাবীর হারকিউলিস মণ্ডল। এটি খুব একটা উজ্জ্বল নয়। তবে এর ১২ শ্রমের ঘটনা বেশ মজার।
মাথায় উপরে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটির নাম “স্বাতী” (Arcturus)। এ তারার উত্তরে, ডানে দুপাশে দুটি তারা, আরো ডানে তিনটি অনুজ্জ্বল তারা, এই তিন তারা দিয়ে ত্রিভুজ ভাবা যায়। তবে, এ সব তারাগুলো দিয়ে একটা ঘুড়ির কল্পনা করা সহজ৷ এটি বুটিস মণ্ডল।
বুটিস মণ্ডলকে পেলে মাথার উপরেই তবে তার থেকে একটু পূর্বে অর্ধবৃত্তাকারে কয়েকটা তারা বেশ সাজানো দেখা দেয়, আসলে দেখতে অনেকটা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বোনা কুলোর মতো৷ আকৃতি অনেকটা ইংরেজি অক্ষর D -এর মত। আমি কুলো দেখতে পেলেও জ্যোতির্বিদগণ এখানে রত্ন খচিত রাজমুকুট কল্পনা করেন৷ এর নাম করোনা, ভাইরাস না, বোরেলিস। করোনা মানে ইংরেজিতে Crown বা রাজমুকুট। আর বোরেলিস হলো উত্তর। এ মণ্ডলের বাংলা নাম, উত্তর কিরীট। তবে আমি একে কুলো মণ্ডল বলতে ভালোবাসি। অনেকটা একই দেখতে আকাশ পটে অন্য একটি মণ্ডলের নাম করোনা অস্ট্রেলিস, দক্ষিণ কিরীট, তবে আমার একে সার্থক কুলো মনে হয় না, ভাঙা কুলো।
চোখ গেল দক্ষিণ-পশ্চিমে। আমার প্রিয়তমা কন্যা রাশিতে। তার ইংরেজি নাম Virgo। সে জুপিটারের কন্যা, সত্য ও ন্যায় বিচারের জন্য বিখ্যাত। পুরাণে পৃথিবীর মানুষ যখন ক্রমশ খারাপের পথে যাচ্ছে তা দেখে সে ন্যায়বিচারের তুলাদণ্ডে পদাঘাত করে আকাশে চলে যায়। সেই থেকে সে আকাশে আছে। তবে আজকের চাঁদ সেখানে অবস্থান করেছে। প্রিয়তমা যেন জানতো, আজ আমি আসবো। তাই এতোদিন তাকে দেখতে না আসায় সে যেন রেগে আছে, তাই মনে হয় চাঁদে সাথে ষড়যন্ত্র করে আমাকে তার একটুখানি দেখিয়ে বাকিটুকু চাঁদের আলোয় ঢেকে শাস্তি দিচ্ছে। প্রিয়তমার প্রথম তারা স্পাইকা, বাংলায় চিত্রা, বাংলার চৈত্র মাসের নাম এই তারা হতে করা। আমি জানিনা প্রিয়তমার রাগ কবে ভাংবে, অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মনে পশ্চিমে তাকালাম।
পশ্চিমে দিগন্তের বেশ উপরে একটি তারা, এর ডানে নিচে দু’দিকে দুটি মোট তিনটি তারা দিয়ে একটা ত্রিভুজ ভাবা যায়, আবার উক্ত দুটি তারা থেকে নিচে দুটি সরলরেখা টেনে দুটি তারা পাওয়া যায়। এই দুটির মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলটার নাম মঘা (Regulus), রাতের আকাশের বিংশতম উজ্জ্বল তারা। এই দুই তারার বামে কিছু তারা দিয়ে বাসায় কাপড় রাখবার হ্যাংগারের মাথা’র মতো কল্পনা করা যায়। আসলে এটা হ্যাংগারের না, সিংহের মাথা। সবমিলে সিংহ রাশি। কল্পনা করা হয় এখানে একটা সিংহ শিকার ধরবার জন্যে ওত পেতে বসে আছে।
চোখ গেল উত্তর-পশ্চিমে। বেশ উজ্জ্বল ৭টি প্রায় সমান উজ্জ্বলতার তারা দেখা যায়। বুঝতে বেগ পেতে হয় না এরা সপ্তর্ষি মণ্ডলের তারা। ইংরেজিতে “Ursa Major”, বাংলায় আসলে বৃহৎ ভল্লুক বলা উচিত হলেও, সপ্তর্ষি নামে বেশ জনপ্রিয়। ছোটবেলায় গ্রামবাংলায় পরিবার পরিজনদের নিকটে কিংবা স্কুলের পাঠ্যবইতে এর কথা জানা যায়৷ ৭টি তারা ও এর নিচের কিছু তারা নিয়ে এই মণ্ডল গঠিত।
বাকি থাকে উত্তর দিক। ঠিক উত্তরে দিগন্তের বেশ উপরে আমাদের প্রিয় ধ্রুবতারা। এর উপরে সপ্তর্ষির সেই ৭তারার মতো ঠিক কম উজ্জ্বল কিছু তারা দিয়ে অনেকটা একই আকারের প্যাটার্ন কল্পনা করা যায়। এটি লঘু সপ্তর্ষি বা শিশুমার মণ্ডল, ইংরেজিতে উরসা মাইনর।
লধু সপ্তর্ষির ধ্রুবতারার উপরে কিছু তারা দিয়ে উটের কুঁজের মতো কল্পনা করা যায়, এই কুঁজের ডানে (পূর্ব দিকে) প্রায় সমান উজ্জ্বলতার দু’টি তারা যেন দুটি জ্বল জ্বল চোখ নির্দেশ করে। এটি ড্রাগন মণ্ডল।
যারা আষাঢ় মাসের আকাশ চিনেন তারা বলবেন আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মণ্ডল মিস করেছি, আসলেই করেছি, আকাশের এই অংশটি বেশ সম্পদশালী। দক্ষিণ-পূর্বে বৃশ্চিকের হুলের বামে বেশ কিছু তারা আছে, এদের সবটুকু নিয়ে ধনু রাশি (Sagittarius) গঠিত। এখানে একজন সেন্টর (ঘোড়ার শরীরের উপর মানুষের মাথা) হাতে তীর ধনু নিয়ে যেন বৃশ্চিককে হামলা করছে। তবে আমার এদিকে উচু দালান আর কিছু মেঘ থাকায় তাকে আজ ভালো করে দেখতে পারিনি। সে যাইহোক, এই মণ্ডলের দুটি তারার নাম Middle Maus ও Nunki বাংলায় যথাক্রমে পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়া। এ দুটি তারা থেকে বাংলায় আষাঢ় মাসের নামকরণ।
আমার পর্যবেক্ষণ শেষ, বিদ্যুৎ এখনও আসেনি। ছাদের পিলারে দাড়িয়ে হেলান দিয়ে প্রিয়তমা কন্যা রাশির দিকে চেয়ে আছি। মুবাইলে গান বাজছে, Tal Bachman এর বিখ্যাত গান –
…She’s blood, flesh, and bone
No tucks or silicone
She’s touch, smell, sight, taste, and sound
But somehow I can’t believe
That anything should happen
I know where I belong …
শব্দ টিকা:
১. আরা – একটি তারামণ্ডল। পুরাণে এটি বলি দেবার জন্য বিশেষ পূজাবেদি।
২. রাশি – আমাদের সূর্য বছরে ১২ মাসে ১২টি নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থান করে। এই ১২টি মণ্ডলকে রাশি বলা হয়।
৩. অভিজিৎ নক্ষত্র – এখনকার দিনে তারা আর নক্ষত্র একই বিষয়, সমার্থক শব্দ। তবে অতীতে একটু আলাদা ছিল। নক্ষত্র বলতে আকাশের বেশ কিছু তারা নিয়ে একটি নক্ষত্র হতো আর, সেই নক্ষত্রের এক একটি জ্যোতিষ্ক-কে বলা হতো তারা তবে পরবর্তীতে নক্ষত্রকেও তারা বানিয়ে ফেলা হয়, এক্ষেত্রে উক্ত নক্ষত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটিকে নক্ষত্রের নাম দিয়ে দেয়। আজকের অভিজিৎ ছিল এককালে অনেক তারা নিয়ে গঠিত নক্ষত্রের নাম, পরে সেই নক্ষত্রের উজ্জ্বল তারার নাম অভিজিৎ দিয়ে দেয়। যাহোক, ধ্রুবতারা চির ধ্রুব নয়। প্রায় ১২,০০০ বছর পর অভিজিৎ নক্ষত্র ধ্রুবতারা হবে৷
_____________
এ লেখার সবই আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বই থেকে শিখেছি। তাই লেখার সময় কোনো সহায়কের দরকার হয় নি। তবে যদি রেফারেন্স এর একান্ত প্রয়োজন হয় এক্ষেত্রে জব্বার স্যারের “তারা পরিচিতি” বইয়ের কথা বলবো। আর অবজারভেশন তো নিজেই করলাম তবে তারাচিত্রের সাহায্যে।
মো. সাজেদুল হক। ছদ্মনাম, “হৃদয় হক”। বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। প্রধানত জ্যোতির্বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখালিখি তার পছন্দের।