জাতি হিসাবে আমরা অনেক অনেক অনেক ঈর্ষাপরায়ন হয়ে যাচ্ছি।
ছেলেবেলায় পড়েছিলাম ‘যে দেশে গুণের কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না’।
আসলেই… খুব বেশীদূর তাকাতে হবে না, পাশের দেশ ভারতের দিকে দেখুন। তারা লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোসলে’কে কতটা সন্মান করে। আর আমাদের রুনা লায়লাকে তাঁর যোগ্য সন্মান রাষ্ট্র কেনো, সাধারণ মানুষও করে না, সাবিনা ইয়াসমিনকে তো তাঁর ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে হয়েছিলো।
কিছুদিন আগে এক নব্য শিল্পীও তাঁর সাথে ঈদের অনুষ্ঠানে কোরাসে কন্ঠ না দেবার জন্য কিঞ্চিৎ বেয়াদবীও করেছিলো, যদিও সেই গায়ক যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচার পেয়েছিলেন তার একজন বিচারক ছিলেন আমাদের সাবিনা ইয়াসমিন।
বুঝেন তাহলে অবস্থা।
এই যদি হয় সেলিব্রেটিদের সন্মান করার/পাবার দশা, তাহলে আমাদের সাধারণ মানুষদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
এবার আসি আসল কথায়, বর্তমান প্রজন্মের কাছে আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয় ‘নিজে পচে বা অন্যকে পচিয়েই কি এখন আলোচনায় আসতে হয়?’ ‘রূচিশীল/মার্জিত সংস্কৃতি চর্চা, একে অপরের প্রতি সন্মানবোধ বলে কি কিছুই আমরা বুঝি না?’
হিরো আলম নামে এক স্বল্প শিক্ষিত/ স্বাক্ষর এক যুবকের নিজের তৈরী ভিডিও আমরা শেয়ারে শেয়ারে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে দিচ্ছি, তাকে পচাচ্ছি। অথচ কেউ তাকে এই ভাঁড়ামি থেকে বের হয়ে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পথ দেখাচ্ছি না।
কেউ কেউ তাঁর এই ভাঁড়ামো দেখতে ফেসবুকে লাইক দিয়ে তাকে জনপ্রিয় ব্যাক্তিদের কাতারে ফেলে দিচ্ছি।
বিশ্বমিডিয়াও বুঝে/না বুঝে তাকেই বাংলাদেশের সংস্কৃতির মাপকাঠিতে পরিনত করেছে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কি খুব উঁচু হয়েছে?
আমাদের ফিল্মে কি সালমান শাহ, রিয়াজ, শাকিব, ফেরদৌস, চঞ্চল, শুভ সহ আরো শক্তিমান নায়ক ছিলো না?
নায়করাজ রাজ্জাকের জীবনী নিয়েই তো যেকোন মিডিয়া বছরের পর বছর পার করতে পারে। আমাদের কি বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেবার মতো হুমায়ূন ফরীদি, এটি এম শামসুজ্জামান, মোশাররফ করিমের মতে দূর্দান্ত অভিনেতা নেই?
আমরা শুধুই সমালোচনা করতেই জানি, কেউ ভুল পথে যাওয়া মানুষটাকে পথ দেখিয়ে আসল মিডিয়া বা মাধ্যমের কাজ করিনা।
ইদানিং আমাদের পচানিতে যোগ হয়েছে কাসেম বিন আবুবকর নামের জনৈক লেখক।
তাকে গ্রাম গঞ্জের স্বল্প শিক্ষিত /শিক্ষিত পাঠক সমাজ বেশী চিনেন। শহুরে মূল ধারার পাঠকসমাজের আড়ালেই ছিলেন তিনি।
মজার ব্যাপার তাঁর লেখা বই/উপন্যাসগুলো দামেও কম, কাটতিও বেশী।
কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপি কাসেম বিন আবুবাকারকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হন তিনি।
আর আমরা, হঠাৎ মেঘ না চাইতে তুফানের মত পেয়ে যাই আমাদের পরবর্তী পচানীর টার্গেট।
আমরা যারা অধিকাংশ তাকে পচাচ্ছি, আমি নিশ্চিত তাদের ৯০% মানুষই তাঁর লেখা পড়িনি। আমরা পচাচ্ছি এর-তার থেকে শুনে শুনে।
আর এই পচানিতে ইন্ধন দিচ্ছেন আমাদের সমাজের বর্তমানে যারা লিখালিখির চেষ্টা করেও আলোচনায় আসতে পারছেন না, কিন্তু সেখানে আন্তর্জাতিক মিডিয়া এই অখ্যাত লেখককে নিয়ে লিখে যাচ্ছে। তাঁর লেখা অনুবাদ করতেও চাইছে।
আমাদের ঈর্ষাকাতর মন তার এই প্রচারে আসা মেনে নিতে পারছে না, শহুরে আমরা ভাবছি আমরা এত যোগ্য! হবার পরেও এএফপি এই বৃদ্ধের লেখাকে প্রশংসিত করছে কেনো?
একজন অখ্যাত বৃদ্ধের কাছে পরাজয় বর্তমান তরুন লেখকেরা মেনে নিতেই পারছেন না।
ঈর্ষা, ঈর্ষা, সবই আমাদের ঈর্ষাকাতর মনের হিসেব।
সত্যি কথা বলতে আমি কাসেম সাহেবের প্রচারণার জন্য কথাগুলো লিখছি না। প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদ পরবর্তী কারো লেখাই আমাকে বিশেষ টানেনা। নবীন লেখকরা লিখছেন, আমরা পড়ছি, কিন্তু লেখায় সেই জাদুর আবেশ কারো লেখায় পাই না। কাসেম সাহেবের লেখায় তো কোন ভাবেই নয়।
কিন্তু আমার একটি ব্যাখ্যা দরকার সন্মানের জায়গাটা থেকে।
একজন লেখকের মূল সন্তুষ্টি তাঁর লেখার গভীরতায় পাঠককে নিবিষ্ট করে দেয়া, সেই কাজটা কাসেম সাহেব করে যাচ্ছেন গ্রাম-গঞ্জের অসংখ্য পাঠক তৈরীর মাধ্যমে।
এই ডিজিটাল ফেসবুকের সময়েও কিছু মানুষ তাঁর লেখা (ফেসবুক ষ্ট্যাটাস নয়) বই পড়ছে। তাঁর বই ছাপিয়ে কিছু প্রেস টিকে আছে, কিছু হকারের পেটে ভাত পড়ছে, কিছু মানুষ তাঁর লেখা পড়ে প্রেমে পড়ছে, ভালোবাসছে এটাই বা কম কি!
হতে পারে তাঁর লেখা শিক্ষিত/বেশী শিক্ষিত সমাজকে টানতে পারেনা তাই বলে দেশের যে সমাজে তাঁর লেখা আবেদন রাখে তাদেরকে অসন্মান কেন করবো?
বিশ্বমিডিয়া তাকে নিয়ে মেতেছে মাতুক, আমরা কি পারিনা বিশ্বমিডিয়াকে দেখাতে আমাদের হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ূন আজাদ, জাফর ইকবাল, শামসুর রাহমান, রকিব হাসান, আনিসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, ইমদাদুল হক মিলন, রাবেয়া খাতুন, হেলাল হাফিজ সহ আরো অনেক অনেক রত্ন আছে।
আমরা কি তাদের বলতে পারিনা এসো, তোমরা দেখে যাও তোমরা যেই কাসেম সাহেবের লেখাকে সোনা বলে আঁকড়ে ধরতে চাইছো, আমাদের সাহিত্যে তাঁর থেকেও বড় বড় অসংখ্য কোহিনূর মণিমুক্তা পড়ে রয়েছে।
এতে করে কাসেম সাহেবকেও সন্মান দেয়া হতো, আমাদের স্বনামধন্য লেখকদেরও সন্মান দিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় দেখানো হতো। তাতে নবীন লেখকেরাও আস্থার একটা জায়গা খুজে পেতেন সামনে এগিয়ে যেতে।
কিন্তু আমাদের মিডিয়া সেটা করবে না বা করার যোগ্যতাও নেই।
আমরা শুধু জানি সমালোচনা করতে, কিন্তু পথ দেখানোর কেউ নেই! কেউ বা যদি পথ দেখানোর চেষ্টা করে, তাকেও সমালোচনার পাত্র বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। সত্যই ‘যে দেশে গুণের কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না’।