একটি জাপানি রাইস কুকার এবং আমি –

রাশেদুজ্জামান পবিত্র


রান্না-বান্না করা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। বিশেষ করে যখন কোনও কাজ না থাকে।আর রান্নায় ব-কলম মানুষের জন্য রান্না করা যেনো রীতিমতো যুদ্ধ জয়ের অনুভূতি। তাই আমার কাছে যুদ্ধ জয়ই মনে হয়। অবশ্য যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসের শুরুটা আরও বেশি কষ্টদায়ক আর সন্দেহ উদ্রেগকারী ছিলো।

বাড়ির অনবরত চাপে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম যে আজ যা থাকে কপালে। রান্না আজ করবোই। তো সেনসি (জাপানে আমার সুপারভাইজর) এর দেয়া রাইস কুকারে খুব উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে যুদ্ধের ঢামাঢোল বাজিয়ে খিচুড়ি রান্না করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম।

যুদ্ধে যেমন প্রথমেই ছোট দুর্বল রাষ্ট্র আক্রমণ করতে হয়, তেমনি রান্না-বান্নাতে সব থেকে সোজা খিচুড়ি রান্না করাই হবে ভাবলাম। সব কিছু একসাথে মিক্সড করে খালি ঘোটা, ঘোটা আর ঘোটা।

তারপর দিয়ে দিলাম রাইস কুকারে।

সময় যায় কিন্তু খিচুড়ির পানি গরম হয়না। মাঝখানে এক বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলে ফেললাম এক ঘণ্টা। ঢাকনা তুলে দেখি পানি অল্প গরম হতে শুরু করেছে। এর মাঝে আবার শুভ্রর সাথে কথা বলা শুরু করেছি ফেসবুকে। ওরে বলতেছিলাম, সেনসি তো দেয়ার সময়ই বলে দিয়েছিলেন যে এটা অনেক দিন ব্যবহার করা হয় না, ঠিক আছে নাকি জানিনা। মনে মনে ভাবলাম শেষ পর্যন্ত নষ্ট রাইস কুকারই পাইলাম নাকি কিডা জানে!!

শুভ্রর সাথেও আলাপ শেষ হয়। কিন্তু আমার চাল ডাল সিদ্ধ হওয়ার নাম নাই। ততক্ষনে আড়াই ঘণ্টা চলে গেছে। আমিও জেদ ধরেই বসে আছি আজ খিচুড়ি খাবোই খাবো। যত ইচ্ছা তত সময় নিক।

অবশেষে মধ্যরাতে দেখলাম পানি কমছে। চাল তো সিদ্ধ হইছে কিন্তু মাগার ডাল সিদ্ধ হইনাই। কিন্তু ঐ যে নিয়ত গুণে বরকত। তাই শুরু করলাম খাওয়া। কিছুক্ষন খাওয়ার পর মুখ আর পেট কোনটাই আর নিতে চাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই ক্ষান্ত দিলাম খাওয়া। আর মনে মনে ধুমাইয়া গালি দিতে থাকলাম শালা রাইস কুকারকে।

উপায় না দেখে আবার বাইরে খাওয়া শুরু। কারণ রাইস কুকারে দুপুরে ভাত চড়াইলে রাতে খেতে হবে।

দুই দিন পর চাইনিজ ফ্রেন্ড লিও ও তার বান্ধবি গেলো আমার বাসায় রান্না করতে। আমি যথারীতি চাল ধুয়ে রাইস কুকারে বসিয়ে দিলাম রান্না করার জন্য।

হঠাৎ দেখি লিও বলতাছে, আরে বেটা করছস কি? এটাতে দিছস কেন?

আমি বললাম, কেন, ঐ যে লাল বাতি জ্বলতাছে, সেনসি বলছে কুক হওয়ার সময় লাল বাতি জ্বলবে।

খুব বিজ্ঞের মতো বললাম যে, এই ঘোড়ার ডিমটা নষ্ট, মেলাক্ষন টাইম লাগবে রে।

ততোক্ষণে আমার রান্নার ক্ষমতা সম্পর্কে ওদের ধারণা হয়ে গেছে। অর্থাৎ মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত বুঝতে আর বাকি নাই ওদের। লিও হাসতে হাঁসতে মাটিতে পড়ে যাবার অবস্থা।

লিও আমারে বলে, দুর বেটা এইটা হইলো ওয়ার্ম অর্থাৎ রান্না হওয়ার পর অল্প আঁচে ভাত গরম রাখার জন্য আর উপরের বাটনটা হচ্ছে কুক যেটা দিয়ে রান্না করে। তুই অল্প আঁচেই যে চার ঘণ্টায় রান্না করছিস এটাই তো মেলা বেশি।

পরে আর কি, নিজের ভাব কমে ফুস হয়ে গেলো আমার।

কিন্তু বাঙালি বলে কথা। হাত তো আমাদের তিনটা। ডান হাত, বাম হাত আর অজুহাত। আমি আবার বললাম, দুর বেটা আমার দোষ কই, সব জাপানিতে লিখা তার মাঝে আবার সেনসি বলছে লাল বাত্তি জ্বলবে। তাই ওটাই হয়তো ভাবছি।

মনে মনে আমি ভাবি, জীবনে রান্না না শিখে কি ভুলটাই না করছি। রান্না না হয় না পারলাম কিন্তু রাইস কুকার টা তো চালানো শিখা দরকার ছিলো।

দেশে আসলে কতো আরামে থাকতাম এখন বুঝতাছি রে পাগলা……


লেখকঃ জাপানে পিএইচডি অধ্যয়নরত থাকাকালীন এই লেখাটি লিখেছিলেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন।

মতামত দিনঃ