অপূর্ণতা

মো. সাজেদুল হক


আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনায়। প্রতি বছর সেখানে যাবার প্ল্যান থাকে। তবে, বিভিন্ন কারণে বেশিরভাগ সময়েই যাওয়া হয়না। কিন্তু, এবার না যাবার কোনো কারন নেই। যেই ভাবা সেই কাজ! ‘গাট্টি-বস্তা’ সব বেঁধে চট্রগ্রাম বাস স্টেশন থেকে সোজা চান্দিনা। সেখান থেকে সিএনজি, তারপর সোজা নানুর বাড়ি।

গ্রামে আমার অন্যতম প্রধান কাজ হলো আকাশ দেখা। তারায় ভরপুর রাতের উজ্জ্বল আকাশ। সুযোগ পেলেই রাত্রিবেলা পরিবার-পরিজনদের থেকে হঠাৎ গুম হয়ে যাই। ছুটে যাই কোনো এক খোলা মাঠের পরিষ্কার আকাশের নিচে। গ্রামের তারাগুলি বেশ উজ্জ্বল, স্বাস্থ্যবান। শহরে রাতের আকাশ বলে কিছু নেই। সে আকাশ লাল-হলুদ আলোয় আলোকিত। সে আকাশে কোনো তারা নেই। আলোক-দূষণ যেন মুছে দিয়েছে শহরের উজ্জ্বল তারাখচিত রাতের আকাশকে। ঠিক যেভাবে ইরেজার মুছে দেয় পেন্সিলের লেখা। তবে যদি দু-চারটে তারার দেখা মেলে, তাদের দেখায় বেশ অনুজ্জ্বল, অস্বাস্থ্যকর। যেন কতকাল ধরে কিছু খায়নি।

গ্রামে সময় যেন দৌড়ায়। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম সবই শহরের তুলনায় বেশ দ্রুত। এমনকি, ঘুম থেকে ওঠাও হয় বেশ ভোরে। নানু বাড়ি থেকে ছোট মা’র বাড়ির দূরত্ব প্রায় বিশ মিনিট। আমার বেশিরভাগই থাকা হয় সেখানে। নানু বাড়ির খাটে চার জনের ঘুমানোর জায়গা করা মুশকিল। গরমকাল হলে তো কথাই নেই! তাই, আমি চলে যাই ছোট মা’র বাড়ি। রাত কাটে সেখানেই। কিন্তু, উনাদের বাড়িতে রাত জেগে আকাশ দেখা সম্ভব হয় না। একেতো প্রধান দরজা বন্ধ থাকে। তারউপর খোলা জায়গা বেশ দূরে। একা একা বেড়িয়েছি তা জানতে পারলে রক্ষে নেই। কিন্তু এবার সেখানে যেতে হয় নি। মামির চাকরির সুবাদে মামা-মামি চান্দিনা চলে গেছেন। ফলে, নানু বাড়িতে ঘুমানোর পর্যাপ্ত জায়গা আছে। সেইসাথে রাত জেগে আকাশ দেখার সুযোগ।

ছোট মা’র বাড়িতে আমার আকাশ দেখা শুরু হয় সূর্যাস্তের পর থেকেই। মাঝে আত্মীয়স্বজনদের সাথে মিলেমিশে নাস্তা, অতপর আবার আকাশ। গ্রামে প্রায় ৯টার ভেতরেই সবাই রাতের ভোজ সেরে নেয়। ভোজ শেষে সকলে মিলে আড্ডায় মেতে উঠে। কখনোবা টেলিভিশন সেটে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু, আমি থাকি বাহিরে। খোলা আকাশের নিচে, খোলা মাঠে। একলা। কখনো দাঁড়িয়ে, কখনোবা বসে কিংবা মাদুরে উপরে শুয়ে। মাঝেমধ্যে দু’একজন মানুষকে এদিকওদিক হাঁটতে দেখা যায়।

এবার ঘুমাবো নানু বাড়ি। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে উঠানে হাঁটছি আর আকাশ দেখছি। উঠান থেকে আকাশ বেশ দেখা যায় বটে কিন্তু কম। গাছপালায় আকাশের বেশকিছু অংশের তারারা পাতার ফাঁকে লুকোচুরি খেলে। নানু বাড়ির পাশ দিয়ে একটা লম্বা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তা ধরে পূর্বে বহুদূর এগোলে বাজার, পশ্চিমে ভোমরকান্দি। বাড়ি থেকে রাস্তা ধরে ১ মিনিট পশ্চিমে হেঁটে গেলেই এলাকার ঈদগাহ মাঠ। ঈদ আর জানাজার নামাজ বাদে এই বড় মাঠ নিঃসঙ্গ। মাঠের সামনে পুকুর। পুকুরের ওপাড়ে বেশ দূরে ঘরবাড়ির আলো জ্বলছে। পেছনে কবরস্থান আর ডানে রাস্তার ওপাড়ে মসজিদ।

পা চালিয়ে ঈদগাহের সামনে চলে এসেছি। ফুরফুরে বাতাস। পশ্চিমে চাঁদের ফালিকে কমলার বড় কোয়ার মতো দেখাচ্ছে। সে যেন বলছে, “পূর্ণিমা হতে বেশি দেরি নেই”। স্বাভাবিক ভাবেই ঈদগাহ মাঠ বড় হয়। এক প্রান্তে দাড়ালে, আঁধারের অন্য দিকে কি আছে তা বোঝা বেশ মুশকিল। চাঁদের স্নিগ্ধতা আর বড় বড় গাছের ছায়া মাঠের অন্য প্রান্তকে আরো গম্ভীর করে তুলেছে। যেন অনেকটা ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। আমি ঢোকার মুখের কাছাকাছি দাড়িয়ে আকাশ দেখছি। উঠান থেকেও বেশ বড় এলাকাজুড়ে মাঠের আকাশের রাজত্ব। এক নজরে অনেকটুকুই দেখা যায়। যেসব তারাগুলি লুকোচুরি খেলছিলো আমি তাদের ধরে ফেলেছি! আর লুকানোর কোনো পথ নেই।

মসজিদের লাইটের আলো এদিকটায় একটু বেশি। ফজরের আগ পর্যন্ত জ্বলবে। মাঝে মাঝে দু’একটা অটোরিকশা বা সিএনজি’র আলো চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এদিকটায় সুবিধে করতে পরছি না। মাঠের অন্যপ্রান্তে পা চালাচ্ছি। মাঠের মাঝের ঠিক সামনের দিকে ইমামের জন্য নামাজের বিশেষ জায়গা৷ এটাকে সম্ভবত মিনার বলা হয়। সিমেন্ট দিয়ে মসজিদের প্রবেশদ্বারের মতো সাজানো। ভেতরে ছোট ফাঁকা জায়গা। দূর থেকে এরদিকে এগিয়ে আসতে একটা জিনিস লক্ষ করলাম। এটার পাশেই কিছু একটা আছে। যতদূর মনে পড়ে, এখানে আগে কিছু ছিলোনা।

অপূর্ণতা 1

চাদঁ বেশ পশ্চিমে ঢেলে পড়েছে। গাছের ছায়া পড়ছে এটার উপর। ভাবলাম মিনারের পাশে নতুন কিছু দিয়েছে হয়তো। ভাবনাটা হয়তো ঠিকই হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। জিনিসটা নড়ছে। ঠিক নড়ছে না, একই জাগায় মৃদুভাবে দুলছে। ঠিক যেন কবিতার ছন্দের মতো! এটা দেখে আমার বুক ধপ করে কেঁপে উঠে। আপাদমস্তকে বিদ্যুৎ গড়িয়ে গেলো। অনেক কষ্টে ঢোক গিললাম। মনকে মানাচ্ছি, “ভয় পাওয়া যাবে না”। কিন্তু মন মানতে নারাজ! গ্রামে অনেক বিখ্যাত ভুতের গল্প আছে। তার মধ্যে একটি হলো, “লাশ-খেকো ভুত”। কিন্তু, সেসব গল্পে লাশ খাওয়ার মচড় মচড় আওয়াজ শোনা যায় কিংবা ভুতের অট্টহাসি। এ গল্পে তা নেই। মনে সাহস জোগাচ্ছি। অনেক্ষণ ধরে সাহস জোগাড় করে সামনে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে এগোচ্ছি। মনকে বুঝাচ্ছি, ছোটখাটো কোনো পশুও হতে পারে অথবা হালকা কিছু, বাতাসে দুলছে। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখি এটা কোনো পশু নয়। মানুষের মতোই কিছু একটা যেন বসে আছে। আলোছায়ায় তার পেছনে চুলের মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। এটা দেখে মনে যত সাহস জোগাড় করেছিলাম, সব হাওয়া হয়ে উড়ে গেছে। হৃৎপিণ্ডের ধপ ধপ শব্দ কানে গিয়ে ঠেকছে। সেইসাথে বাতাসে যেন ভেসে আসছে গানের গুণ গুণ সুর। আমি যেন নিঃশ্বাসটুকু নিতে ভুলে গেছি। ভয়ে গলার ঢোক আটকে আছে। গিলতে পাড়ছি না। যেন জমে গেছি। না পাড়ছি উল্টোপথে হাঁটা দিতে। চোখ বন্ধ করে পুরো মস্তিষ্কের ভেতর ব্যাখ্যা খুঁজছি। শুধু একটা  লজিক্যাল ব্যাখ্যা। কিন্তু পেলাম না। চোখ খুলে সেদিকটায় ভেবলার মতো তাকিয়ে আছি। এমন সময় একটু জোরে বাতাস এলো। চুলের মতো জিনিসগুলো বাতাসে উড়ছে। ঠিক সেসময় লক্ষ করলাম, জিনিসটার কাধে কিছু একটা ঝুলানো, সেটাও বাতাসে বইছে। দেখতে যেন ওড়নার মতো! আমি এযাবৎ যত ভুতের গল্প জেনেছি, সেখানে কোনো ভুত এভাবে ওড়না রাখে না। হয় ঘোমটা টেনে রাখে, নাহয় খোলা চুল ছড়ানো থাকে। মনে আবার সাহস জোগাতে থাকি। সাহস কুয়োর জলের মতো ফুরিয়ে এসেছে। রীতিমতো যেভাবেই পারছি জল ঢালছি। আটকে থাকা ঢোক টুকু গিলে, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। তারপর, প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্বেও এক পা এগোলাম। অদৃশ্য কিছু একটা যেন চায়, আমি এগোই। আরো এক পা সাহস করে এগোলাম। আমি জানি, এখান থেকে বাড়ি অবধি পৌঁছানোর সাহস এবং শক্তি কোনোটাই এখন আমার মধ্যে নেই। যতটুকু সাহস তখনও বিদ্যমান তা জ্বালিয়ে বলে উঠলাম, “এইযে শুনছেন!”। আমার কথা শুনে জিনিসটা নড়েচড়ে উঠলো। মাথার পেছনে হাত দিয়ে ওড়নার মতো জিনিসটা ছড়িয়ে দিলো। তারপর, আমার দিকে আস্তে আস্তে ঘুরে আসছে। কথাটি বলার সময় আমার মস্তিষ্ক ভেবে বলেছিলো কিনা – আমি জানি না। কিন্তু, ঘুরে তাকানোর পর যা দেখবো, তা দেখে আমি অজ্ঞান হবো কিনা – মস্তিষ্ক সেই নিয়ে ব্যাস্ত।

জিনিসটা ঘুরে তাকানোর পর, সেদিন যা দেখলাম, মোটেই তা ভয়ের কিছু নয়! পাতার ফাঁকে চাঁদের আলোয় চেহারা সম্পূর্ণ বোঝা যাচ্ছেনা বটে, কিন্তু এটা ভুতের চেহারা নয়। একটি মেয়ের চেহারা, হালকা ঘোমটা টেনে আছে। আমার দিকে কিচ্ছুক্ষণ ফিরে চেয়ে মিষ্টি কণ্ঠে উত্তর দিলো, “জি, বলেন!”। আমি স্বস্তির এক বড় নিশ্বাস ছেড়ে হাটু ভেঙে বসে পড়লাম। আস্তে আস্তে ভয় কেটে যেতে লাগলো। সজীবতা ফিরে পেতে লাগলাম। মেয়েটি বললো, “আপনি ঠিক আছেন তো?” আমি উঠে দাড়িয়ে বললাম, “হ্যাঁ, ঠিক আছি। তবে, আপনি এখানে? এতো রাতে… তাও আবার একলা!” মেয়েটি একটু গম্ভীর শ্বাস ফেলে বলে, “শুধু মেয়ে বলে এসব বলছেন? তাছাড়া, একই প্রশ্ন আপনাকেও করা যায়। ” আমি জোর করে একটু হাসি এনে বললাম, “না মানে, শুধু মেয়ে দেখে বলতে যাবো কেন? তাছাড়া, আমি এসেছি আকাশ দেখতে।” কথাটি শোনার পর মেয়েটি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে৷ অতঃপর, একটু জোর গলায় উৎফুল্ল ভাবে বলে ওঠে, “যাক! এই গ্রামে আমি শুধু একটা নই!!” আমি বোকা ভাবে তাকিয়ে বলি, “বুঝলাম না।” মেয়েটি শান্তভাবে বলে, “আগে ভাবতাম এই গ্রামে শুধু আমি একা পাগলের মতো আকাশ দেখি। কিন্তু আপনার কথায় বুঝলাম, আমি একা না।” আমি বোকাসোকা ভাবে বললাম, “ইয়ে মানে.. আমি আসলে শহরে থাকি। গ্রামে ছুটি কাটাতে এলাম।” মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “সে আপনি যেখানেই থাকুন না কেন। এই গ্রামেরই তো!” আমি একটু হেসে বলি, “হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক।” তারপর মেয়েটি বলে উঠলো, “তা, আর কত দাঁড়িয়ে থাকবেন। এদিকটায় বসুন। আমার মতো পা ঝুলিয়ে। অন্যরকম ভালো লাগবে। ” আমি আরো সামনে এগিয়ে যাই। এদিকটা পুকুর কিছুটা থেকে উপরে। ৪-৫ হাত হাত নিচে পুকুর। পুকুরটা ভালোই গভীর। আমি সামনের দিকে একটু ঝুঁকে দেখে একপা পিছিয়ে এলাম। তারপর বললাম, “না থাক। আমার দাঁড়িয়ে দেখার অভ্যাস আছে।” এটা দেখে মেয়েটি একটু হেসে বলল, “পুকুর দেখে ভয় পেলেন। সাঁতার জানেন না নিশ্চয়ই?” আমি বললাম, “শিখার সুযোগ হয়নি ঠিক।” শুনে মেয়েটি অভয় দিয়ে বলল, “আমি সাঁতার জানি। এই পুকুরের প্রতিটি কোন আমার চেনা। পড়ে গেলে তুলে আনতে পারবো। ভয় নেই। অন্তত, আমি থাকতে পানিতে চুবে মরবেন না। এবার নির্ভয়ে বসুন।” অভয় পেয়ে কিছুটা সাহস জোগিয়ে সাবধানে বসে পড়ি। পুকুরের উপর এভাবে পা ঝুলিয়ে বসে থাকায় আসলেই অন্যরকম অনুভূতির কাজ করে৷ বড় পুকুর। পুকুরের একটু উপর দিয়েই বাতাস বইছে। এই বাতাসগুলো তুলনামূলক ঠান্ডা। পায়ে লাগামাত্র শীতল শিহরণ কাজ করে। শরীর যেন এই বাতাসে মিলিয়ে যেতে চায়।

এরপর বেশ কিছুক্ষণ দুজনই নিশ্চুপ। নিজেরা নিজেদের আকাশে তাকিয়ে আছি। এই মেয়েটাকে বেশ কিচ্ছুক্ষণ আগেও ভুত ভেবে কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম। কথাটা মাথায় আসতেই একটু জোরে হেসে ফেলি আমি। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “কি ব্যাপার! হাসছেন যে?” আমি দ্রুত বলি, “না, তেমন কিছু না।” শুনে মেয়েটি বলে, “আহ, বলেনই না। আমিও একটু শুনি আর হাসি।” আমি একটু ইতস্ততভাবে বলি, “ইয়ে মানে… আপনাকে দূর থেকে দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম….” “কী ভেবেছিলেন?”, বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে সে। “ভেবেছিলাম কোনো….” “ভুত। তাইতো?” জলদি বলে উঠে সে। আমি লজ্জা পেয়ে বলি, “না মানে, হ্যাঁ।” কথাটি শুনে মেয়েটি জোরে খিক খিক করে হেসে উঠে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে, সত্যি বলতে, আপনিই প্রথম নন কিন্তু!” আমি বোকা হয়ে বললাম, “মানে বুঝিনি।” মেয়েটি আরো একটু হেসে বলল, “এর আগেও অনেকে আমাকে ভুত ভেবে ভয় পেয়েছে। একবার তো একলোক অজ্ঞান হয়ে এই মাঠে পড়েছিলো৷ পরদিন হুজুর ডেকে দোয়া-দরুদ পড়ে এই জায়গা বন্ধ করেছেন৷ কিন্তু লাভ হয়নি। আমিতো আর ভুত না।” কথাটি শুনে আমি হাসতাম। যদি না, আমিও মেয়েটিকে ভুত ভেবে ভয় পেতাম। তারপর শান্ত গলায় বললাম, “সত্যি বলতে, এভাবে ভুত বনে যাবার ঘটনা আমারো একটা আছে।” মেয়েটি আগ্রহ দেখিয়ে বলে, “তাই নাকি? কোথায়? শহরে? বলেন শুনি।” আমি উত্তর দিলাম, “না, শহরে না। এই গ্রামেই। পানিপাড়া প্রাইমারি স্কুল তো চিনো নিশ্চয়ই? সেখান থেকে আরো সামনের দিকে এগোলে আমার বড় মা’র বাড়ি। সেখানে একটা পরিত্যাক্ত ফসলের মাঠ আছে৷ সেইখানে প্রায়ই নির্জন। রাত্রিবেলা কেউ বেরোয় না। সেই সুবাদে কোনো আনাগোনা নেই। আমি আরামসে আকাশ দেখছি। হঠাৎ, কোনো এক বাচ্চা ছেলে আমাকে দেখে ভুত ভেবে ভয় পেয়েছে। তারপর তার ভাইকে ডাক দিয়ে নিয়ে আসে৷ ভাইয়ো ছোটই৷ যখন দেখে আমি মানুষ, তারপর বলে শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে। কি একটা অবস্থা।” কথাগুলো শুনে মেয়েটি হাসতে থাকে। তারপর বলে উঠে, “আমার কি মনে হয় জানেন? আমাদের মতো আরো দু’চারজনের জন্যই বুঝি গ্রামে এসব ভুত গুলোর জন্ম।” শুনে আমরা দুজনেই হাসতে থাকি। এ সময় যদি এদিকটায় কেউ হেটে যায়, নিশ্চিত ভুতপ্রেতরা আড্ডায় মেতে উঠেছে ভেবে ভয়ে পালাবে৷ সেদিন রাতে খুব একটা তারা দেখা হলো না৷ দুজনেই গল্পে মেতে উঠেছি। আমার ঝুলিতে ছোটখাটো গল্প। ছোটই হবার কথা। হাজার হলেও আমি শহুরে সৌখিন জ্যোতির্বিদ্যা প্রেমি। কিন্তু মেয়েটির গল্পের ঝুড়ি বিশাল। আমাদের গল্পগুলোর একটা শিরোনাম দেওয়া যেতে পারে, “ভুতপ্রেত কুসংস্কার এবং জ্যোতির্বিদ্যা”। গল্পের একপর্যায়ে হুট করে মেয়েটি চেচিয়ে উঠে, ” হায়! হায়!! কয়টা বাজে?” আমি বললাম, “এই আনুমানিক ১২টা” মেয়েটি বলে উঠে, “ঘড়ি না দেখেই সময়?” আমি হালকা হেসে বলি, “না ঠিক ঘড়ি না দেখে না। তবে সহজ উপায় আছে একটা৷” মেয়েটি আগ্রহী ভাবে বলে, “কিভাবে তা বলেন, শুনি।” আমি ব্যাখ্যা করতে লাগলাম, “আমি যখন এই ঈদগাহে আসি তখন প্রায় ১০টা।। তখন ওইযে তারাটি দেখছেন, সেটা ছিলো ওই তালগাছের পাতার ঠিক উপরে। যেন তালগাছ ছুয়ে আছে। এখন সে অনেকটুকুই সরে এসেছ। একটা সহজ হিসেব হলো, তারারা প্রতি ঘণ্টায় ১৫° অবস্থান পরিবর্তন করে। এই ১৫° হলো আপনার শাহাদাত আর কনিষ্ঠ আঙুলের দূরত্ব। এখন মেপে দেখো, ২ বার ১৫° করে মাপতে হয়৷ যা দ্বারায় ৩০° অর্থাৎ ২ ঘণ্টা। তারমানে আমি ১০টায় এলে এখন ১২টা।” মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, “বাহ! এই জিনিস কোথায় শিখলেন?” আমি বললাম, “কোনো এক বইতে পড়েছি। ” মেয়েটি চট করে বলে উঠে, “ওহ আচ্ছা! রাত ১২টা মানে অনেক রাত। আপনি শহরে থাকেন। তাই হয়তো গভীর মনে হবে না৷ কিন্তু গ্রামে অনেক গভীর। আমাকে এখন উঠতে হবে।” দুজনেই উঠে দাড়ালাম। আমি জিজ্ঞেস কিরলাম, “আপনি কি প্রতি রাতেই আসেন?” মেয়েটি উত্তর দেয়, “জি, প্রতি রাতেই।” আমি বলি,”কাল তাহলে আসবেন নিশ্চয়ই। ” মেয়েটি বলে, “হ্যাঁ, আসবো। আপনি আসবেন?” আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, “যতদিন গ্রামে আছি।” মেয়েটি হালকা হেসে বলে, “আচ্ছা, তাহলে কাল দেখা হবে।” এই বলে যে, ওপাড়ের অন্ধকার ভুতুড়ে গাছপালার ভীড়ে মিলিয়ে যায়। ওপাড়ে কেউ থাকতো বলে আমি আগে জানতাম না। এরপর আমিও নানুর বাড়ি চলে আসি।

পরদিন ভোর বেলা থেকেই প্রচণ্ড জ্বর। জ্বরে যেন গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া নেই, গোসল নেই৷ সম্ভবত কালকের অপ্রয়োজনীয় ভয় থেকেই এই জ্বরের উৎপত্তি। বিকেল থেকে কমতে শুরু করে। সন্ধ্যায় জ্বর নেই বললেই চলে। সারাদিন তেমন কিছুই খাওয়া হয় নি। তাই, সন্ধ্যায় বেশ পেট পুরে খেলাম। অতঃপর সুযোগ খুঁজছি, কখন বেরোবো। এখন বেরোবার চেষ্টা করলে পরিবার পরিজন ধরে বসবেন। কড়া গার্ড দিবেন। তাই, অপেক্ষা করে রইলাম। রাত্রিবেলা সুযোগ বুঝে, দে ছুট! গিয়ে দেখি মেয়েটি যথারীতি বসা। আমি হালকা কেশে বললাম, “তা, কেমন আছেন আজকে?” আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “ভালো। আপনি?” আমি বললাম, “এইতো, জ্বর হয়েছিলো। তবে এখন ভালো। তা কখন আসেন?” মেয়েটি আকাশে তাকিয়ে উত্তর দিলো, “ইশার পর মসজিদ ফাঁকা হয়ে গেলে।” আমি পা ঝুলিয়ে বসে বললাম, “ওহ। তা গতকাল তো গল্পে কাটিয়েছি। আপনার আকাশ প্রেমি হয়ে উঠার গল্পটা তো শোনা হলো না!” মেয়েটি হালকা হেসে বলা শুরু করে, “আমার দাদা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, একইসাথে আকাশপ্রেমি। যুদ্ধে এক পা হারান। যুদ্ধ শেষে প্রতি রাতে আমাকে নিয়ে এদিকটায় আসতেন৷ তারা চেনাতেন, গল্প বলতেন। এভাবেই আমার আকাশের প্রেমে পড়া শুরু। দাদার একটা বেশ পুরাতন বই ছিলো। সেখানে তারাদের নিয়ে বেশ কথা আছে৷ বইটা এখনো আমার কাছে আছে, কিন্তু অনেক পৃষ্ঠা নেই। দাদা চলে যাওয়ার পর, আমি পাওয়ার আগে বইটা অনেক বছর অযত্নে ছিলো, উইপোকা ধরেছে। কিছু পাতা পাঠযোগ্য ছিলো, তাছাড়া উনার ডাইরিতেও আকাশ নিয়ে টুকিটাকি লেখা ছিলো। তবে বেশিকিছু না, মূলত সেটা মুক্তিযুদ্ধের ডাইরি। আবার গ্রামে বইয়ের দোকানে ঘুরে বেড়াই। এসব নিয়ে বই খুবই কম। তবে, পেলে পড়ি। এভাবেই টুকিটাকি জানা আরকি।” আমি উনার দাদার জন্য দুঃখিত হলাম আর বললাম, “সেই হিসেবে বইটা বেশ পুরনো৷ দেখতে পেলে ভালোই হতো।” মেয়েটি বললো, “তাহলে কাল আপনার জন্য নিয়ে আসবো।” আমি খুশিমনে বললাম, “বাহ! তাহলে ভালোই হবে। তা, এ মাসের আকাশের সব তারামণ্ডলগুলো নিয়ে ধারণা আছে কিংবা এদের পুরাণ নিয়ে?” মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দেয়, “না, সবগুলির নেই। অল্পকিছুর আছে। তাছাড়া, পুরাণ নিয়ে বইতে খুবই কম ছিলো।” আমি বললাম, “যেগুলো চিনেন, জানেন আমাকে বললেন। যেগুলো চিনেন তাদের পুরাণ নিয়ে যতটুকু জানি বলার চেষ্টা করবো। তারপর আপনার অচেনা মণ্ডলদের একে একে চেনাবো।” মেয়েটি উৎফুল্ল হয়ে বলা শুরু করে। আমিও তাদের পুরাণ নিয়ে যা জানি তা জানানে লাগলাম। সেই রাত্রি পুরাণকাহিনিতেই কেটে গেলো।

পরের রাত্রিরে সে বইটা নিয়ে আসে। ধরেই বোঝা যায় খুবই পুরানা বই। বইটা পড়া উচিত বলে মনে হলো আমার। বাংলায় আগের জ্যোতির্বিদ্যার অবস্থা জানার জন্য। বললাম, “তা, একদিনের জন্য ধার পাওয়া যাবে বইটা?” মেয়েটি হেসে বলে, “একদিন কেন? যত দিন লাগে রাখুন।” তারপর বই নিয়ে কোনো কথা নেই। যথারীতি তাকে নতুন মণ্ডল চেনাতে শুরু করি। সেইসাথে মণ্ডলের পুরাণ আর বিশেষ তারা সমূহ। যেসব মণ্ডলের পুরাণ পুরো মনে আসে না কিংবা ঠিক কোন কোন তারা দিয়ে গঠিত তা মনে করতে পারি না। সেগুলো দুজনে মিলে বানিয়ে নেই। নিজস্ব মণ্ডল, নিজস্ব গল্প। আকাশের চাঁদ যেন পূর্ণিমা হবো হবো করছে। আর আমি তাকে বলছি চাঁদ মামার গল্প। না, সেখানকার চরকি কাঁটা বুড়ির গল্প না। চাঁদের পৌরাণিক গল্প। তার ২৭ নিবাসের গল্প, বলছি, চাঁদ কেন সুধাংশু, কেন পুরাণে তার ক্ষয় হয়, অমাবস্যার নাম কিভাবে এলো। এভাবেই কখনও কল্পনার জগতে হারিয়ে যাই আমরা, আবার ফিরে আসি বাস্তবতায়। সত্যি বলতে এর আগে কখনো আকাশ পট নিয়ে এতো কথা বলিনি। এভাবে সময় কাটাইনি। এরূপ তৃপ্তি আগে কখনও জোটেনি। অনলাইনে অল্পস্বল্প হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই প্রথম। এর স্বাদ সম্পূর্ণ আলাদা, যা বলে বোঝানো অসম্ভব। যেন আমার আত্মা হাজার বছরের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।

পরদিন সকালেই বইটা নিয়ে বসে পড়ি। যেমনটা বললাম, প্রাচীন বই। অনেক তথ্যেরই হালনাগাদ প্রয়োজন। কিছু পৃষ্ঠার ছবি খাওয়া, কিছুর লেখা খাওয়া আবার কিছু পৃষ্ঠার প্রায় সবটুকুই উইপোকা পেটে পুরে নিয়েছেন। বুঝিনা, এতো বই খায় তবুও এদের জ্ঞানের অভাব। পড়তে বেশিক্ষণ লাগেনি। পড়ার ফাঁকে আম্মার কিছু কথা কানে এলো। বুঝলাম, গ্রাম ছাড়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আর বেশি দেরি নেই। ভাবলাম, যাবার আগে মেয়েটাকে একটা উপহার দাওয়া যায়। কি উপহার দিবো তা মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি। পকেটে পঞ্চাশটা টাকা পড়ে আছে। এখানে আসার পর কিছু খাওয়ার জন্য আব্বা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালিকি অতো সহজেই অতিথি আপ্যায়নের ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে দিবে? সে টাকা খাওয়া-দাওয়ার কাজে লাগেনি ঠিকই, কিন্তু উপহারের কাজে লেগেছে। এ টাকার সাথে নিজের কিছু টাকা যোগ করে কাছের এক দোকান থেকে বেশকিছু দিস্তা খাতা, খাতা বাধাইয়ের জন্য কিছু সুতা, একটা পেন্সিল, একটা ইরেজার, একটা শার্পনার এবং একটা কলম কিনি। পেন্সিল কম্পাসেরও খোঁজ করছিলাম কিন্তু পাইনি। দোকানিরা জানান বেশ দূরের বাজারে যেতে হবে। তাই, এটা না নিয়েই ফেরত আসতে হলো। কিন্তু আমার তাতে অতো সমস্যা নেই। কম্পাস ছাড়াই কিভাবে হহত দিয়ে বৃত্ত আঁকতে হয় – তা আমি জানি। অতঃপর কাজে লেগে পড়ি। ওকে হাতে আঁকা আকাশের মাসিক মানচিত্র এবং সেইসাথে হাতে লেখা ছোট করে তারামণ্ডলের পরিচিতির একটা নোটখাতা বানিয়ে উপহার দিবো। এখানে ইন্টারনেটের অবস্থা করুন। একঘর নেটওয়ার্কের দেখা মেলে সেটা দিয়ে ভালোমতো কথাও বলা যায় না। ইন্টারনেট চালু করলে সে ঘরটাও হাওয়া হয়ে যায়৷ আমার ই-বুক কালেকশনও বাসার পেনড্রাইভে ঘুমুচ্ছে। ভাগ্যিস মুবাইলে তারাচিত্রের অ্যাপ্লিকেশন ছিলো। সেটা দিয়ে বারো মাসের মণ্ডলের ম্যাপ একে ফেলতে পারবো। কিন্তু ৮৮টা মণ্ডলের বেশিরভাগই সংক্ষেপে লিখতে হবে৷ আমার স্মৃতিশক্তি কম। সবগুলোর বিস্তারিত পড়লেও বেশিরভাগই ভুলে যাই। মাঝে মাঝে মনে হয় শার্লক হোমসের মনেরাখার মাইন্ড প্যালেস টেকনিকটা পেলে খুব একটা মন্দ হতো না। যাহোক, কাজে লেগে পড়ি।

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সারা বেলা এই কাজ করে পাড়ি দিলাম। শুধুমাত্র খাওয়া আর ওয়াশরুম ছাড়া কাজ ছেড়ে যাইনি। এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে হালকা জলখাবার খেয়ে নিলাম। তারপর কিছুটা সময় আত্মীয়দের সাথে কাটিয়ে প্রাচীন বইটা নিয়ে ন’টা নাগাদ ঈদগাহ মাঠে গেলাম। কিন্তু মেয়েটি আজ এখানে নেই। ভাবলাম হয়তো একটু পর চলে আসবে। ন’টা গড়িয়ে দশটা, দশটা গড়িয়ে এগারোটা হয়ে চললো। কিন্তু মেয়েটির দেখা নেই। আমি ওপাড়ের ঘুটঘুটে অন্ধকার জায়গাটায় তাকিয়ে আছি, কখন যে আসবে। কিন্তু সে এলোনা। আমি আরো অল্পক্ষণ থেকে চলে এলাম। পরদিনও একই কাজে ব্যাস্ত। হাতে খুব বেশিদিন সময় নেই। জলদি শেষ করতে হবে৷ কিন্তু সেদিন রাত্রেও মেয়েটির দেখা পেলাম না। ভাবলাম কোনো ঝামেলায় পড়লো নাকি! মনস্থির করলাম আরো একরাত দেখি। তারপর না হয় মেয়েটির খোঁজ নেওয়া যাবে। সেদিন রাত্রে বেশিক্ষণ থাকিনি। উপহারের কাজ শেষ করার উদ্দেশ্যে চলে এলাম। পরদিন প্রায় ভোর থেকে কাজ ধরলাম। আম্মা জানালেন কাল বিকেলে শহরে উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। আমারো অবশ্য আজকেই সবকাজ সেরে যাবে। আমার হাতের লেখা অতোটা ভালো না। তাই, সুন্দর করে লেখা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তারপরও যথেষ্ট পরিষ্কার করে লিখেছি। দুপুরের আগে কাজ শেষ। এবার শুধু খাতাটা বাধাই করা বাকি। বাধাই শেষ। দুপুরের খাবার শেষে এক লম্বা ঘুম দেই। এমনিতেই আমি ঘুমপ্রেমি মানুষ। এক ঘুমেই সন্ধ্যা কারবার। ঘুম থেকে উঠে কিছু খাইনি। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পর বই এবং উপহারটা নিয়ে বেরোই। আজো গিয়ে দেখি পুরো মাঠ ফাঁকা। কোথাও মেয়েটি নেই। আমি অপেক্ষার প্রহর গুনছি৷ প্রতিটি মুহূর্ত যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠছে। কখন আসবে সে? মনের ভেতরে কি যেন ছটফট করে লাফাচ্ছে। চারিদিক কেমন যেন শূন্যতায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সারা রাত অপেক্ষা করে তার দেখা পেলাম না। ঠিক করলাম, কাল মেয়েটির খোঁজ নিবো।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করেই বেরিয়ে গেলাম মেয়েটির খোঁজে। রাত্রি বেলা মাঠের ওদিকটা ভুতুড়ে মনে হলেও দিনের বলা বেশ সুন্দর একটা জায়গা। কিছু দূরে চোখ যেতেই ছোট একটা পাড়া দেখা যায়। খোঁজ করতে গিয়ে মনে এলো, মেয়েটির নাম জানা হয়নি। কিন্তু বাড়িটা খুঁজে পেতে অতো ঝামেলা পোহাতে হয় নি। বইতে তার দাদার ছিলো। তা দিয়েই বাড়িটার সন্ধান পেয়ে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি বড় একটা তালা ঝুলছে। পাশের বাড়িটি থেকে জিজ্ঞেস করি, এনারা কোথায়? উত্তরে জানতে পারি সদর হাসপাতালে। কথাটা শুনেই মনে একধরনের খারাপ অনুভূতির জন্ম হতে থাকে৷ সেটা ঝেড়ে ফেলে বই আর উপহারটির সাথে এক খালাতো ভাইকে নিয়ে সোজা সদর হাসপাতালে দৌড়। রিসিপশন থেকে মেয়েটির কেবিন নম্বর উদ্ধার করে সিড়ি বেয়ে উঠছি। যতই এগোই, মন বিষন্ন হয়ে আসে। দূর থেকে বাতাসে যেন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। এ আওয়াজ আমি চিনি। কোনো এক সন্তানহারা মায়ের হাহাকারের কান্না শব্দ এটি৷ আমি চিনি কারণ, আমার বন্ধুর মৃত্যুতে আমি আন্টিকে এভাবে কান্না করতে শুনেছি। আমি জানি, দেরি হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি মেয়েটি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে তার মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে৷ রাত্রিবেলায় মেয়েটির চেহারা ভালোভাবে দেখতে পাইনি। এখন দেখছি।  ফুটন্ত গোলাপের মতো মিষ্টি এক চেহারা। যেন পূর্ণিমার চাঁদ প্রতি পূর্ণিমায় আস্তে আস্তে তার চেহারার রূপ দিয়েছে। আমি বিছানাটির পাশে মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকি। চোখ গড়িয়ে জল বইতে চায় আমি দেইনা। সময় করে মেয়েটির দেহ নিয়ে যাওয়া হয়। আমি মেয়ের মায়ের শান্ত হবার আশা নিয়ে বসে থাকি। কিন্তু এ কান্না কবে শেষ হবে কেউ জানে না। উনি কিছুটা শান্ত হলে সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তারপর বলি, “আপনি আমাকে চিনবেন না৷ কিছুদিন আগে শহর থেকে বেড়াতে এসেছি। রাতের বেলা আকাশ দেখার সুবাদে আপনার মেয়ের সাথে পরিচয় হয়৷ ওর থেকে একটা বই ধার করেছিলাম।” এই বলে ব্যাগ থেকে বইটা বের করে উনার হাতে দেই। উনার পাশে ছোট একটা মেয়ে আছে৷ মেয়েটার ছোট বোন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, “তুমি জানো? তোমার বোনটি কোথায় আছে?” মেয়েটি মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, আমি জানি!” আমি বললাম, “কোথায় আছে সে?” মেয়েটা উত্তর দেয়, “মা বলেছেন আমার বোন তারা দেখতে ভালোবাসতো। তাই তারারা আমার বোন কে তাদের দেশে নিয়ে গেছে। রাতে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি আমার বোন।” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে ভাঙা গলায় বলি, “হ্যাঁ, ঠিক তাই।” তারপর, ব্যাগ থেকে মেয়েটির জন্য বানানো উপহারটা তার বোনের হাতে দিয়ে বলি, “এটা তোমার বোনের জন্য এনেছিলাম। কিন্তু তাকে তো এটা দিতে পারবো না। তাই এটা তোমার জন্যে।” এটা পেয়ে ছোট মেয়েটি খুশি হয়ে যায়। তার মাকে দেখাতে থাকে। জিনিসগুলো দিয়ে চলে আসার জন্য এক পা এগোতেই মেয়েটির মা ডাক দিয়ে বলেন, “বাবা! এই বইটা তুমি রেখে দাও।” তারপর তিনি তার শাড়ির ভেতর থেকে একটা ভাজ করা কাগজ আমার হাতে দিয়ে বলেন, “আর এই চিঠিটা রেখো। আমার মেয়ে হাসপাতালে যেটুকু জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল সেইটুকু সময়ে এটা লিখে যায়৷ আর বলে, কোনো এক ছেলে বই ফেরত দিতে এলে, তাকে যেন এটা দেই।” আমি চিঠিটা ধরে মূর্তির মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর সেটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখি৷ তিনি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলে চললেন, “আমি জানিনা আকাশে কি আছে। কিন্তু আমার মেয়ে জানতো। তোমার সাথে আকাশ দেখার কথা বলেছিলো সে আমাকে। আমার মেয়েটাকে গতবছর ডাক্তার দেখানোর পর থেকে হাসতে দেখিনি, কখনও খুশিমনে থাকতে দেখিনি। তোমার কথা বলার পর থেকে সে খুবই খুশি ছিলো। আমি তোমার জন্য দোয়া করি, বাবা। তুমি জীবনে অনেক সুখী হও অনেক দীর্ঘজীবী হও তুমি।” এই বলে তিনি আবারও কান্না ভেঙে পড়েন।

সেদিন যুহরের নামাজের পর মেয়েটির জানাজা হয়। কবর দেওয়া হয় ঈদগাহের কবরস্থানটিতে। সবাই চলে যাবার অনেক্ষণ পরেও আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি। সেদিন আর খাওয়া-দাওয়া করিনি। বিকেলে যথারীতি শহরের উদ্দেশ্য রওনা হই। শরের বাসায় আসতে আসতে প্রায় রাত হয়ে যায়। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে, কাপড়চোপড় না খুলে, রাতের খাবার না খেয়েই সোজা ঘুম। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমানোর চেষ্টা করলেও ঘুম আর আসে না৷ বিছানা ছেড়ে প্লাস্টিকের চেয়ার, লাল লাইটটা এবং চাবি নিয়ে ছাদে যাই৷ ছাদে চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। এমন সময় পকেটে হাত যেতেই চিঠিটা হাতে লাগে। চিঠিটা বের করে লাল লাইটটা জ্বলিয়ে পড়তে শুরু করি। সেখানে লেখা –

“কেমন আছো তুমি? অবশ্যই ভালো! এতদিনের কথাবার্তার পর তোমাকে তুমি বললে রাগ করবে না নিশ্চয়ই। চিঠি লিখতে গিয়ে মনে পড়লো, তোমার নামটা আমার জানা হলো না। কিন্তু এতক্ষণে আমার নামটা ঠিকই জেনে গেছো নিশ্চয়ই! চিঠিটা পেয়েছো মানে, আমি আর নেই। এজন্যে আবার দুঃখ করোনা কিন্তু! সত্যি বলতে আমি জানতাম যে, আমার হাতে বেশি সময় নেই। গতবছর ডাক্তার বলেছিলেন আমি নাকি বেশিদিন বাঁচবো না। তাই স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করতে লাগলাম। বেশিদিন বেঁচে থাকার জন্য নয় কিন্তু! প্রতি রাত আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করতাম যেন স্রষ্টা এমন কাউকে পাঠান যার সাথে আমি প্রাণ খুলে আকাশ নিয়ে কথা বলতে পারি। স্রষ্টা এর আগে আমার কোনো প্রার্থনা রাখেননি। ভেবেছিলাম শেষ প্রার্থনাটুকুও তিনি রাখবেন না৷ সেদিন রাতে তোমাকে দেখার পর এই ভাবনা ধুলোয় মিশে যায়৷ আমার শেষ প্রার্থনাটুকু অন্তত তিনি রেখেছেন। আমার এতো খুশি দেখে কে! সে যাইহোক, আমার বইটা তোমাকে উপহার স্বরূপ দিয়ে দিলাম। আর, আমার মতো এতো অল্প বয়সে উপরে চলে আসবে না কিন্তু! তোমাকে অনেক অনেক বছর বাঁচতে হবে। কম বয়সে মরে মজা নেই। সত্যি বলতে কোনো বয়সেই হয়তো মৃত্যু আরামদায়ক হয় না, আবার হয়তো হয়। যাহোক, সাঁতার টুকু সময় করে শিখে নিও। আর সব সময় ভালো থেকো। আলবিদা।”

পড়ার সময় চোখের জল চিঠিটায় গড়িয়ে পড়ে। হাত দিয়ে জল মুছে চোখ পরিষ্কার করি। তারপর আকাশের দিকে তাকাই। চাঁদ আজ পূর্ণিমা হয়ে গেছে। পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলি। পূর্ণিমার চাঁদকে দেখে কবি সুকান্তের “হে মহাজীবন” কবিতার বিখ্যাত চারটি চরণ মনে আসে। তবে সেটি অন্যভাবে। –

“প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা,
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি
একাকিত্বের রাজ্যে পৃথিবী-বিস্বাদময়:
পূর্ণিমা-চাঁদে যেন আমি তারে খুঁজি।”


পার্সেইড উল্কাবৃষ্টি 2

মো. সাজেদুল হক। ছদ্মনাম, “হৃদয় হক”। বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। প্রধানত জ্যোতির্বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখালিখি তার পছন্দের।

মতামত দিনঃ